‘এখনকার মতো সাহস পেলে অন্য মেয়েদের এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতাম না’

ছবি: স্টার

মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ গ্রামে বাড়ি সাথি বিশ্বাস (১৭) ও ইতি রানি মন্ডলের (১৬)। তারা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্য। কদিন আগে নেপালের মাটিতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ইতিহাস গড়া মেয়েদের মধ্যে আছেন দুজন। তাদের ভূমিকা দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোলরক্ষকের। দরিদ্র পরিবারের সাথি ও ইতি বড় হয়েছেন অনাহারে-অর্ধাহারে।

ইতির বাবা মনোজিৎ কুমার মন্ডল পেশায় ভ্যানচালক। পাশাপাশি ডেকোরেটরের দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পৈতৃকভাবে পাওয়া জমিতে রয়েছে ছোট দুটো টিনের ঘর। ভ্যান চালিয়ে ও দিনমজুর হিসেবে কাজ করে চার মেয়ের তিন জনকে তিনি বিয়ে দিয়েছেন। মনোজিৎ বলেন, 'আগের তিন মেয়েকে খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছি। ইতি যদি ফুটবল না খেলত, তাহলে এতদিনে ওর বিয়ে হয়ে যেত। এখনকার মতো সাহস পেলে অন্য মেয়েদের এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতাম না।'

ইতির বাবা জানান, গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে থাকে নানা রকমের দুশ্চিন্তা। বিয়ে দিতে না চাইলেও মানুষজন বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। তবে ইতির মতো হতে পারলে বাবা-মায়ের আর চিন্তা থাকে না।

ছবি: বাফুফে

ইতির মা উন্নতি রানী বাংলাদেশ শিরোপা জেতায় ভীষণ খুশি। তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতি জানতে মেয়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে কথা হয়নি। কারণ, স্মার্টফোন নেই তাদের। তিনি বলেন, 'আমাদের চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। তাতে এখন আর কোনো দুঃখ নেই। অনেক সময় টাকা ধার করে ওকে দিয়েছি খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন এতটাই আনন্দ হচ্ছে যে কান্না চলে আসছে বারবার।'

শুরুর দিকে স্থানীয়দের অনেকে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে হাসি-তামাশা করেছে। অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেছে সাথি ও ইতিকে। এখন যেন চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। সবাই তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

কয়েক বছর আগে গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্যোগে মেয়েদের ফুটবল অনুশীলন চালু হয়। শুরুর দিকে অংশ নেওয়াদের একজন সাথি। ওই সময় তার পরিবার তাকে খেলতে দিতে আগ্রহী ছিল না। সাথির মা সুদেবী বিশ্বাস বলেন, 'মেয়ে যখন ফুটবল খেলতে যেত, গ্রামের অনেকে টিটকারি করত। আরও কত কিছু বলত!'

সাথির দাদা বৈকন্ঠ কুমার বিশ্বাস বলেন, 'মেয়েরা যখন ফুটবল খেলা শুরু করে, তখন এলাকার লোকজন কটু কথা বলত। এখন তারাই বলে, "তোমার নাতনি তো মানুষ হয়ে গেছে।" এলাকায় আমাদের সুনাম বেড়েছে।'

সাথির বাবা বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, 'বাজারে একটা ছোট স্টুডিও আছে আমার। সেখান থেকে অল্প আয়েই চলে সংসার। আমার মেয়ে এত দূর যাবে ভাবিনি। দেশ-বিদেশে খেলতে যাচ্ছে, এটা বিশাল কিছু মনে হয়।'   

এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন সাথি। তবে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যাওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তার মা সুদেবী এ বিষয়ে বলেন, 'পরীক্ষা দিবে নাকি খেলতে যাবে, এটা ও জিজ্ঞেস করেছিল। আমি সিদ্ধান্তটা ওর শিক্ষকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। দেশের জন্য খেলে ও যে সম্মান এনেছে, এতে আমি খুবই খুশি।'

গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি। সেখান থেকে বিকেএসপি হয়ে জাতীয় দল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মূলত ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি ও সহকারি শিক্ষক শহিদুল ইসলামের উদ্যোগে এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলা ও অনুশীলন শুরু হয়।

প্রধান শিক্ষক দেবজ্যোতি বলেন, 'মেয়েরা যে এই গ্রামসহ মাগুরার নাম উজ্জ্বল করেছে, এতেই আমি খুশি।'

জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়টি থেকে ১৪ জন মেয়ে বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছেন। এদের মধ্যে আট জনসহ মোট দশ জন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলছেন।

মেয়েদের খেলার জন‍্য বড় একটি মাঠের ব্যবস্থা করার দাবিও উঠেছে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে। মাগুরা জেলা ক্রীড়া অফিসার অনামিকা দাস বলেন, 'এবারের বিজয় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করছে। এ এক অভূতপূর্ব বিজয়। আমরা চিন্তা করছি, এই মেয়েদের জন্য ভালো একটি মাঠের ব‍্যবস্থা করা যায় কিনা।'

মাগুরা জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম জানান, আগামী কয়েক দিনের মধ‍্যে জেলা প্রসাশন ও ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গৌরবময় সাফল্য নিয়ে দেশে ফেরা ইতি ও সাথিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে।
 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago