সাফ জিতলেন ঋতু-মনিকারা, আর চথুইমা এখন দৌড়াতেও পারেন না

চথুইমা জানান, ২০১২ সালে তিনি বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন।

'আমার বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর আমি অনেকবার উঠে দাঁড়ানোর, দৌড়ানোর ও খেলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। যতবারই চেষ্টা করেছি, ততবারই আমি আমার আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছি। আমি ইনজুরির পরোয়া করি না। আমি আবার খেলতে চাই কিন্তু আবার আঘাত পেলে আমার চিকিৎসা কে করবে? কে দেখভাল করবে? এখন মাঠে নামতে ভয় লাগে।'

কথাগুলো চথুইমা মারমার। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে এই প্রতিবেদক যখন ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন, 'হ্যালো! চথুইমা  মারমা বলছেন?'

'না, আমি চথুইমা নই। আমি তার বন্ধু। চথুইমা এখনো কাজ থেকে ফেরেনি,' উত্তর আসে ফোনের ওপাশ থেকে।

রাত যখন ১০টা ৪০ মিনিট, চথুইমার নম্বর থেকে ফিরতি ফোনকল আসে, 'হ্যালো! আমি চথুইমা মারমা বলছি। আপনি কে বলছেন? কার ব্যাপারে কথা বলতে চান?'

'আমি একজন সাংবাদিক। আমি আপনার ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাই! আপনার কি একটু সময় হবে?' জানতে চান এই প্রতিবেদক।

'না, আমি ফুটবল নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না। ফুলবল আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। ২০১৪ সালের পর বাফুফের কেউ আমার খবর রাখেনি,' জবাব চথুইমার।

২০ বছর বয়সী চথুইমার বর্তমান পরিচয় হলো তিনি চট্রগ্রামের কালুরঘাটে একটি জুতা তৈরি কারখানার শ্রমিক। অথচ ২০১৪ সালেও তার পরিচয় ছিল বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের একজন চৌকস স্ট্রাইকার। গত মাসে ইতিহাস গড়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা- যাদেরকে এখন বাংলাদেশের মামুষ ঘরে ঘরে চেনে, এক সময় তাদের সতীর্থ হিসেবে খেলেছেন রাঙামাটির এই চথুইমা।

'তারা আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও পরে জাতীয় পর্যায়ে খেলেছি। তারা সবাই এখন খেলছে আর আমি দৌড়াতেও পারছি না। এটা প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে,' বলেন চথুইমা।

'আমি ২০১১ সাল থেকে ফুটবল খেলা শুরু করি। আমার খেলা দেখে মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (কাউখালী উপজেলার অন্তর্গত) শিক্ষক বীর সেন চাকমা স্যার নিজ খরচে আমাকে তার স্কুলে নিয়ে যান এবং মনিকাদের সঙ্গে খেলতে দেন।'

চথুইমা জানান, ২০১২ সালে তিনি বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন। সেবার তার ঘাগরা উচ্চ বিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হয়েছিল। তিনি ওই বছরই শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। ২০১৪ সালে চথুইমা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের দলে ছিলেন। একই বছরের শেষদিকে অনুশীলনের সময় তার বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) তাকে সব ধরনের ফুটবল কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়।

'২০১৪ সালের অক্টোবরে যখন আমি ইনজুরিতে পড়ি, তখন বাফুফে আমাকে দুই বা তিন হাজার টাকা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিল এই টাকা দিয়ে যেন ভালো চিকিৎসা করাই কিন্তু সেই সময় চিকিৎসার জন্য আমার লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন ছিল। টাকার অভাবে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করতে পারিনি। পরে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও কিছু সদয় ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে পায়ে অস্ত্রোপচার করাই', বলেন চথুইমা।

'তবে এখনও আমার পায়ের ইনজুরি সারেনি। এখনও আমি ভালো করে হাঁটতে পারি না। পাহাড়ে উঠতে পারি না। আমার ইনজুরির পর বাফুফের কেউ এক মুহূর্তের জন্যও আমার খোঁজ রাখেনি।'

'আমি যখন খেলতাম, তখন টাকার অভাব ছিল না। ইনজুরির পর আমার পরিবার অনেক আর্থিক সমস্যায় পড়েছিল। ২০১৭ সালটা চালাই এক বান্ধবীর আর্থিক সাহায্যে। ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একটি জুতার কারখানায় কাজ পাই। প্রথমে অনেক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে হতো। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ যখন জানল যে আমি একজন ফুটবলার ছিলাম, তখন আমার বসার ব্যবস্থা করেন তারা।'

'আমার বৃদ্ধ বাবা-মা রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বটতলী পাড়ায় থাকেন। তাদের বয়স ৬০-এর ঊর্ধ্বে। তারা কোনো কাজ করতে পারেন না। আমি এখানে মাসে বেতন হিসেবে পাই মাত্র নয় হাজার টাকা। তাই দিয়ে কোনোরকমে চলি। বাড়িতে টাকা পাঠাই। এছাড়া, আমার ছোট একটা বোন মা-বাবার সাথে থাকে। তারা এখন আমার উপার্জনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।'

'গ্রামে থাকার জন্য আমার বাবা-মায়ের একটি ছোট কুঁড়েঘর ছিল। সম্প্রতি সেটিও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরে কাছেই আরেকটি খুপরি তৈরি করে বসবাস করছেন তারা। সাংবাদিকরা আমাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার পর সরকার আমাদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি বাড়ি বরাদ্দ করেছে। তবে সেটা এখনও প্রস্তুত হয়নি,' যোগ করেন চথুইমা।

সাফ জয়ী বাংলাদেশ নারী জাতীয় দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের কাছে চথুইমার সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চথুইমা একজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় ছিল। সে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছে। অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি নারী চ্যাম্পিয়ন বাছাইপর্বের দলেও সে ছিল।'

কেন বাফুফে চথুইমার চিকিৎসার ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি জানতে চাইলে কোচ ছোটন বলেন, 'সেটা ছিল বাংলাদেশে নারী ফুটবলের শুরুর সময়। তখন আমাদের সেই সুযোগ ছিল না কিন্তু এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সময়ে যদি লক্ষ্য করেন, আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ১৬ লাখ টাকা খরচ করে চার জন খেলোয়াড়ের (তাদের মধ্যে সিরাত জাহান স্বপ্নাও আছেন, যিনি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন) লিগামেন্ট সার্জারি করিয়েছি।'

Comments

The Daily Star  | English
BNP office in Nayapaltan

Column by Mahfuz Anam: Has BNP served its supporters well?

The BNP failed to reap anything effective from the huge public support that it was able to garner late last year.

9h ago