টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪: শ্রীলঙ্কার মধুর প্রতিশোধ

২০১৪ টি-টোয়েন্টির বিশ্বআসর বসেছিল বাংলাদেশে। এই বিশ্বকাপের শুরু হয় নতুনের কেতন উড়িয়ে। প্রথমবারের মতো ক্রিকেটপ্রেমীরা দেখে ১৬ দলের বিশ্বকাপ। আসরের ফরম্যাটেও আনা হয় পরিবর্তন, সুপার এইটের পরিবর্তে দেখা মেলে সুপার টেনের। ঘরের মাঠে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ রাঙাতে পারেনি টাইগাররা, অন্যদিকে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ক্ষুদ্রতম সংস্করণের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।

২০১৪ টি-টোয়েন্টির বিশ্বআসর বসেছিল বাংলাদেশে। এই বিশ্বকাপের শুরু হয় নতুনের কেতন উড়িয়ে। প্রথমবারের মতো ক্রিকেটপ্রেমীরা দেখে ১৬ দলের বিশ্বকাপ। আসরের ফরম্যাটেও আনা হয় পরিবর্তন, সুপার এইটের পরিবর্তে দেখা মেলে সুপার টেনের। ঘরের মাঠে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ রাঙাতে পারেনি টাইগাররা, অন্যদিকে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ক্ষুদ্রতম সংস্করণের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।

দলগুলোর ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া ছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের অন্যতম নিয়মিত ঘটনা। গোটা টুর্নামেন্টে শতরানের নিচে অলআউটের ঘটনা ঘটে আটবার। শুধু তাই নয়, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বনিম্ন ১০ সংগ্রহের চারটিই এসেছিল সেই বিশ্বকাপে। আসরের প্রথম ম্যাচেই আফগানিস্তানকে মাত্র ৭২ রানে গুটিয়ে দেয় মুশফিকুর রহিমের বাংলাদেশ।

তিন উইকেট নিয়ে এর নেতৃত্ব দেন সাকিব আল হাসান। আব্দুর রাজ্জাক, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, ফরহাদ রেজারাও জ্বলে উঠেছিলেন সেই ম্যাচে। তাদের বিষে নীল হয়ে দুঃস্বপ্নের মতো শুরু করে আফগানরা। একই দিনে নেপাল-হংকং ম্যাচেও দেখা মিলে একই চিত্রের। নেপালের দেওয়া ১৫০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৬৯ রানেই শেষ হয়ে যায় হংকংয়ের ইনিংস।

আসরের তৃতীয় ম্যাচে আইসিসির তৎকালীন সহযোগী সদস্য আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যায় পূর্ণ সদস্য জিম্বাবুয়ে। সিকান্দার রাজা, ব্রেন্ডন টেইলরদের ১৬৩ রান তিন উইকেট হাতে রেখে টপকে যায় আইরিশরা। ২০ মার্চ শক্তির বিচারে এগিয়ে থাকে আফগানিস্তানকে হারিয়ে সাড়া জাগায় নেপাল। পরের ম্যাচেই আরেক সহযোগী সদস্য হংকংয়ের বিপক্ষে হারের লজ্জায় পড়ে বাংলাদেশ।

মাত্র ১৬.৩ ওভারেই গুটিয়ে যায় মুশফিক বাহিনী, তার আগে স্কোরবোর্ডে উঠে মাত্র ১০৮ রান। সহজ লক্ষ্য কঠিন বানিয়ে দুই উইকেটের জয় পায় হংকং। শেষ বলে রাজ্জাককে যখন ছক্কা হাঁকান হাসিব আমজাদ, কেঁদে উঠেছিল কোটি টাইগার ভক্তের হৃদয়।

২০১৪ বিশ্বকাপে উত্তেজনার ছিল না কোনো কমতি। ২১ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ডসের ম্যাচটি আজও গেঁথে আছে ক্রিকেট ভক্তদের স্মৃতিতে। সুপার টেন নিশ্চিত করতে জয়ের বিকল্প ছিল না ডাচদের। তবে জয়ই যথেষ্ট ছিল না, ছিল নেট রান রেটের মারপ্যাঁচও। এদিকে আয়ারল্যান্ডের জন্য সমীকরণটা ছিল বেশ সহজ, জয় পেলেই পরের রাউন্ডে চলে যেত তারা।

আইরিশদের প্রথম ইনিংস শেষে নেদারল্যান্ডসের বিদায় দেখে ফেলেছিলেন অনেকেই। সুপার টেনে যেতে ১৪.২ ওভারের মধ্যে কেভিন ও'ব্রায়ানদের গড়া ১৮৯ রানের পাহাড় ভাঙতে হতো ডাচদের। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও নিজেদের ওপর আস্থা হারায়নি পিটার বোরেনের দল। বল হাতে মলিন পারফরম্যান্সের পর ব্যাটিংয়ে দেখা মেলে 'অচেনা' নেদারল্যান্ডসের।

লোগান ভ্যান বিক ও বেন কুপার ছাড়া ব্যাট হাতে নামা প্রত্যেক ডাচ ব্যাটারই চালান ধ্বংসযজ্ঞ। ১৫ বলে ৩১ রান করেন অধিনায়ক বোরেন। তবে সব সীমা ছাড়িয়ে যান তার ওপেনিং সঙ্গী স্টিফেন মাইবার্গ। মাত্র ২৩ বলে সাতটি ছক্কা ও চারটি চারের মারে খেলেন ৬৩ রানের অতিমানবীয় ক্যামিও। ওয়ান ডাউনে নামা ওয়েসলি বারেসিও চালিয়েছিলেন তাণ্ডব। ২২ বলে ৪০ রান এসেছিল তার ব্যাট থেকে।

তবু সুপার টেনের মক্কা বহুদূর ছিল ডাচদের। সেই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে টপ কুপার যেন করে ফেলেন একটু বাড়াবাড়িই। ৩০০ স্ট্রাইক রেটে মাত্র ১৫ বলে করেন ৪৫ রান। সেই ইনিংসে চারের মার একটি হলেও ছিল ছয়টি ছক্কার মার। শেষ পর্যন্ত তার ঝড় থামলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বিশাল লক্ষ্য নেদারল্যান্ডস টপকে যায় ১৩.৫ ওভারেই। ইতিহাস গড়ে সুপার টেনে পা রাখে ডাচরা।

গ্রুপ এ তে দুর্ভাগ্যের বলি হয় নেপাল, বাংলাদেশের সমান পয়েন্ট নিয়েও নেট রান রেটে পিছিয়ে থাকায় বিদায় নেয় তারা। সুপার টেনে পা রাখে টাইগার বাহিনী। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে বাকি আট দেশ সরাসরি সুপার টেন পর্ব দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করে সেবার।

এই পর্বের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। ধোনির দলের কাছে সেই লড়াইয়ে পাত্তা পায়নি মোহাম্মদ হাফিজের দল। ১৩১ রানের মামুলি লক্ষ্য ৭ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে যায় ভারত।

২০১৪ বিশ্বকাপ ভক্তদের উপহার দিয়েছিল বেশ কয়েকটি স্নায়ুচাপের ম্যাচ। ২২ মার্চের শ্রীলঙ্কা-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটি ছিল তেমনই। শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ৫ রানে জিতেছিল লঙ্কানরা। উত্তেজনার কমতি ছিল না ২৪ মার্চের দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ড ম্যাচেও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে স্নায়ুর লড়াইয়ে পেরে না উঠলেও কিউইদের বিপক্ষে ঠিকই এই চাপ সামলে নেয় প্রোটিয়ারা। নিশ্চিত হারতে বসা ম্যাচ জিতে নেয় ফাফ ডু প্লেসির দল।

জয়ের জন্য শেষ দুই বলে তিন রান প্রয়োজন ছিল নিউজিল্যান্ডের, তখনই নাথান ম্যাককালামকে অধিনায়ক প্লেসির ক্যাচে পরিণত করেন ডেল স্টেইন। ৬২ রান করা রস টেইলর তখনও ছিলেন ক্রিজে। তবে শেষ বলে স্টেইনের ওয়াইড ইয়র্কারে বড় শট খেলতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত দুই রানের হৃদয়বিদারক হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে কিউইরা।

দিনের অপর ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৩৯ রানে অলআউট হয়ে বিব্রতকর এক নতুন রেকর্ড গড়ে নেদারল্যান্ডস। আজও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বনিম্ন সংগ্রহ হয়ে আছে সেটি। পরের ম্যাচে বাংলাদেশও বিধ্বস্ত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ক্যারিবীয়দের দেওয়া ১৭২ রানের লক্ষ্যে নেমে ৯৮ রানে থামে টাইগারদের ইনিংস। ক্রিশমার সানটোকি ও স্যামুয়েল বদ্রির সামনে দাঁড়াতেই পারেননি তামিম-সাকিবরা।

২৭ মার্চ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আবারও স্নায়ুর চাপ সামলে নেয় প্রোটিয়ারা। সেই ম্যাচে ডু প্লেসির দল পায় ৬ রানের কষ্টার্জিত জয়। মাঝে বাংলাদেশকে আট উইকেটের বড় ব্যবধানে হারায় ভারত। ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে আবারও দেখা মেলে তুমুল উত্তেজনার। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে ৩ রানের জয় পায় প্রোটিয়ারা।

বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের মতো বড় দলগুলোকেও শতরানের নিচে অলআউট হওয়া দেখেছে ২০১৪ বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তান প্রত্যেককেই একবার করে বিব্রিতকর এ পরিস্থিতিত মুখোমুখি হয়েছে। চরম উত্তেজনার সুপার টেন পর্ব শেষে সেমির লড়াইয়ে জায়গা করে নেয় ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রথম সেমিতে বৃষ্টি আইনে লঙ্কানদের বিপক্ষে পরাজয় বরণ করে উইন্ডিজ। সেমির দ্বিতীয় লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৭২ রান ৬ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে যায় ভারত। বৃষ্টির কারণে পিছিয়ে যায় ফাইনাল। রিজার্ভ ডেতে মাঠে গড়ায় ম্যাচটি। ফাইনালে অসাধারণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং প্রদর্শনী দেখায় শ্রীলঙ্কা। আগে ব্যাট করে ৪ উইকেটে ১৩০ রানের বেশি করতে পারেনি ভারত।

স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ৫৮ বলে ৭৭ রানের ইনিংস খেলেন বিরাট কোহলি। জবাবে কুমার সাঙ্গাকারার ফিফটি ও মাহেলা জয়াবর্ধনে-থিসারা পেরেরার বিশোর্ধ্ব ইনিংসে দুই ওভার এক বল হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় লাসিথ মালিঙ্গার দল। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল হারের প্রতিশোধ নেয় লঙ্কানরা। মিরপুরের গ্যালারি পরিণত হয় এক টুকরো শ্রীলঙ্কায়।

২০১০ এর আসরের মতো ২০১৪ বিশ্বকাপেও দুশো পার স্কোর করতে পারেনি কোন দল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৬ রানই ছিল সেবার সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। ব্যাটিংয়ে ৩১৯ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন কোহলি। আসরের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের অ্যালেক্স হেলসের অপরাজিত ১১৬ রান ছিল সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। ১২ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির। ক্রিকেট বিশ্বকে উত্তেজনার জ্বরে কাঁপিয়ে বিদায় নেয় আরও একটি বিশ্বকাপ।

Comments

The Daily Star  | English
BNP office in Nayapaltan

Column by Mahfuz Anam: Has BNP served its supporters well?

The BNP failed to reap anything effective from the huge public support that it was able to garner late last year.

8h ago