টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬: শিহরণ জাগিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস

'কার্লোস ব্রাথওয়েট! রিমেম্বার দ্য নেম। হিস্ট্রি ফর ওয়েস্ট ইন্ডিজ।' ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ উঠতেই সবার আগে স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে কমেন্ট্রি বক্সে ইয়ান বিশপের সেই চিৎকার। আদতেই সেবার ইতিহাস গড়েছিল ক্যারিবীয়রা। প্রথম দল হিসেবে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জয় আরও একবার জানান দেয় এই ফরম্যাটে ক্রিস গেইল, কায়রন পোলার্ডরা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন।

চার-ছক্কার মেলা বসিয়ে ক্যারিবিয়ানরা ভরপুর বিনোদন দিলেও বাংলাদেশের জন্য ছিল যথারীতি হতাশার এক বিশ্বকাপ। নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সবচেয়ে আক্ষেপের ম্যাচ ভারতে অনুষ্ঠিত সেই আসরেই খেলে টাইগাররা। নাগপুরে জিম্বাবুয়ে-হংকং দ্বৈরথ দিয়ে শুরু হয় প্রথম রাউন্ডের খেলা। সেই ম্যাচে আসরের প্রথম জয় তুলে নেয় হ্যামিল্টন মাসাকাদজার দল।

সেবারও প্রথম রাউন্ড দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করতে হয় বাংলাদেশকে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আরেকটু হলেই অঘটন ঘটিয়েছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। তবে কোটি ভক্তের মান রেখেছিল টাইগাররা, শেষ দশ ওভারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে মেলে ৮ রানের কষ্টার্জিত জয়। ব্যাট হাতে অনবদ্য ৮৩ রান দিয়ে দারুণভাবে টুর্নামেন্ট শুরু করেন তামিম ইকবাল।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচটি ভেসে যায় বৃষ্টিতে। সেই ম্যাচেও হেসেছিল তামিমের ব্যাট, মাত্র ২৬ বলে ৪৭ রান করে জ্বলে উঠার ভিত করেছিলেন মজবুত।

হঠাৎই ১৩ মার্চ ঘটে অদ্ভুত এক ঘটনা। বিশ্ব দেখে ছয় ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ। ধর্মশালায় সেবার বৃষ্টির প্রকোপ ছিল একটু বেশিই। আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ডসের ম্যাচটি তাই ছয় ওভারে নেমে আসে। ডাচদের দেওয়া ৬০ রানের লক্ষ্যে আইরিশরা থেমে যায় ৪৭ রানেই।

আয়ারল্যান্ডের জন্য হতাশার হলেও একই দিনে বাংলাদেশের হয়ে ইতিহাস লেখেন তামিম, প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে হাঁকান সেঞ্চুরি (১০৩*)। সেই বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিও ছিল সেটি। ম্যাচটি ৫৪ রানের বড় ব্যবধানে জিতে নেয় টাইগাররা।

গত আসরের মতো ২০১৬ তেও ছিল না কোনো সুপার এইট পর্ব। সুপার টেনের প্রথম ম্যাচে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয় ভারত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৭ রানের মামুলি লক্ষ্যে তাড়া করতে গিয়ে মাত্র ৭৯ রানে গুটিয়ে যায় মাহেন্দ্র সিং ধোনীর দল। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, সুরেশ রায়না, যুবরাজ সিংদের অতিমানবীয় ব্যাটিং লাইনআপের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল ভক্তদের। দুই স্পিনার মিচেল স্যান্টনার ও ইস সোধি মিলে ৭ উইকেট শিকার করেন সেই ম্যাচে।

পরের দিন প্রতিবেশীদের মতো বাংলাদেশও হার দিয়ে শুরু করে দ্বিতীয় পর্ব। পাকিস্তানের ২০২ রানের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ১৪৬ রান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় মাশরাফি বাহিনীকে।

২০১৬ বিশ্বকাপের শুরু থেকেই যেন বিশাল রান তাড়ায় নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের মিশনে নেমেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ইংল্যান্ডের ১৮২ রান হেসে খেলে পার করে ফেলে তারা। আসরের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন গেইল, তার ৪৮ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংসে ১১ বল বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে নোঙ্গর ফেলে ক্যারিবীয়রা। সেই ইনিংসে ১১টি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন ইউনিভার্স বস।

১৮ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড ম্যাচ ফিরিয়ে আনে ২০১৪ বিশ্বকাপের নেদারল্যান্ডস-আয়ারল্যান্ড ম্যাচের স্মৃতি। ২২৯ রান করেও পার পায়নি প্রোটিয়ারা। জেসন রয়ের ১৬ বলে ৪৩ ও জো রুটের ৪৪ বলে ৮৩ রানের টর্নেডোতে জয় ধরা দেয় ইংলিশদের হাতেই। এর আগে হাশিল আমলা, কুইন্টন ডি কক ও জেপি ডুমিনির ফিফটিতে রানের ইমারত গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।

এর ঠিক পরের দিন ছিল ভারত-পাকিস্তান মহারণ। তবে ১৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ধোনীর দল ৬ উইকেটের সহজ জয় পেলে সমর্থকরা বঞ্চিত হন এই লড়াইয়ের প্রকৃত উত্তেজনা থেকে। আসরের ২২তম ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের হট ফেবারিট অস্ট্রেলিয়ার। ৯ বল বাকি থাকতেই ৩ উইকেটের জয় নিয়ে সেদিন মাঠ ছেড়েছিল ক্যাঙ্গারুরা।

২৩ মার্চের ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ আজও পোড়ায় কোটি টাইগার ভক্তকে। মাত্র ১ রানের যন্ত্রণাদায়ক হারে বিষে নীল হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিমরা। শেষ তিন বলে দরকার ছিল মাত্র দুই রান। অযথা বড় শট নিতে গিয়ে আউট হন মুশফিক ও রিয়াদ, শেষ বলে এক রান নিতে গিয়ে রান আউট হন মোস্তাফিজুর রহমান।

নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হারে মনোবল হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ দল, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচে মাশরাফি বাহিনী গুটিয়ে যায় মাত্র ৭০ রানেই। ২৭ মার্চ ২০১৬ বিশ্বকাপে নিজেদের একমাত্র হারের তেতো স্বাদ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেদিন তৎকালীন সহযোগী সদস্য আফিগানিস্তানের ১২৩ রান পার করতে পারেনি সেই আসরে রান তাড়ায় খ্যাতি অর্জন করা ড্যারেন সামির দল।

সুপার টেন শেষে সেমির লড়াইয়ে জায়গা করে নেয় ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও নিউজিল্যান্ড। প্রথম সেমিফাইনালে কেন উইলিয়ামসন, মার্টিন গাপটিলদের বেশ সহজেই হারায় ইংল্যান্ড। ৪৪ বলে ৭৮ রান করে এর নেতৃত্ব দেন রয়।   

মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে সেমির দ্বিতীয় ম্যাচে টিকিটের পুরো পয়সা উসুল হয়ে যায় দর্শকদের। ভারত হারলেও ম্যাচটির পরতে পরতে ছিল উত্তেজনা। বিরাটের ৮৯ রানের একপ্রান্ত আগলানো ইনিংসে ১৯২ রানের বড় সংগ্রহ পেয়েছিল ভারত। তবে জনসন চার্লস (৫২), লেন্ডন সিমন্স (৮২) ও আন্দ্রে রাসেলের (৪৩) সামনে ধোপে টিকেনি এই রান।

দুই বল হাতে রেখেই ৭ উইকেটের বিশাল জয় পায় ক্যারিবিয়ানরা। ফাইনালে ডোয়াইন ব্রাভো (৩ উইকেট) ও কার্লোস ব্রাথওয়েটের (৩ উইকেট) বোলিং তোপে টেনেটুনে ১৫৫ রান করে ইংলিশরা। শুরুটা অবশ্য করে দিয়েছিলেন স্যামুয়েল বদ্রী ও আন্দ্রে রাসেল। তবে শেষভাগে কিছুটা বেশি রান দিয়ে ফেলেন উইন্ডিজ বোলাররা।

রান তাড়ায় নেমে এক মারলন স্যামুয়েলস ছাড়া থিতু হতে পারছিলেন না কেউই। মাঝে ব্রাভোর ২৭ বলের ২৫ রানের ইনিংস উইকেট পতন আটকালেও বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রয়োজনীয় রানরেট। ফলে শেষ ওভারে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য দরকার পরে ১৯ রান।

পৃথিবীর যেকোন ব্যাটারই এমন পরিস্থিতিতে নার্ভাস হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ব্রাথওয়েট যেন বুকের মধ্যে লালন করেছিলেন কেবল একটি স্বপ্ন, যার জন্য আগুনের ওপর চলতেও হয়তো পিছপা হতেন না তিনি। আগে কখনোই ব্যাট হাতে তেমন স্মরণীয় কিছু না করা এই বোলিং অলরাউন্ডার প্রথম চার বলেই শেষ করে দিলেন খেলা, সীমানার দড়ির ভেতর রাখলেন না একটি বলকেও।

চতুর্থ বলটি 'মিস হিট' করেও সীমানার দড়ি পার করান ব্রাথওয়েট। তার অবদানেই আরও একবার বিশ্ব দেখে ক্যারিবীয় দানবের গর্জন। প্রথম অধিনায়ক হয়ে দুবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন সামি। ৬৬ বলে ৮৫ রানের ইনিংসের কল্যাণে স্যামুয়েলসের হাতে ওঠে ম্যাচ সেরার পুরস্কার। আসরজুড়ে ২৭৩ রান ও এক উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হন কোহলি।

২৯৫ রান করে সেবার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তামিম ইকবাল। ১২ উইকেট নিয়ে ব্যাটারদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন আফগান অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবি। এদিকে তামিমের ওমানের বিপক্ষে করা ১০৩ রান পার করতে পারেনি কেউই, ফলে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে যায় সেই ইনিংসটি।

২০১৬ বিশ্বকাপে দুশো পার স্কোর হয়েছিল চারটি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রান তাড়া করে ২৩০ করার ম্যাচেই সর্বোচ্চ দলীয় রানের তালিকায় নিজেদের শীর্ষে তোলে ইংল্যান্ড। সময়ের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নজরে আসে এই বিশ্বকাপে। ক্রিকেটের প্রসিদ্ধ ধারণার বাইরে গিয়ে সফল হন অনেক ক্রিকেটার। ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটের পরবর্তী যুগ কেমন হতে চলেছে তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল সেই আসরেই।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago