অভুক্ত মানুষ কেন সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দেয়?

দ্য ডেইলি স্টারসহ দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গতকাল একটি ছবি ছাপা হয়। ছবির বিষয়বস্তু ছিল সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ৩টি ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়ার (লাংকমপাড়া, জয়চন্দ্রপাড়া ও রেংয়েনপাড়া) বাসিন্দারা। গত ২৬ এপ্রিল একটি রাবার কোম্পানির লাগানো আগুনে তাদের জুমচাষের বাগান পুড়ে যায়। ফলে জুম বাগানের উপর নির্ভরশীল ম্রো ও ত্রিপুরা পরিবারগুলো চরম খাদ্য সংকটে পড়ে। পাড়ার সুপেয় পানির ঝর্ণাটিও প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই চরম মানবেতর পরিস্থিতিতেও কেন তারা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে আরও কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে।

প্রথম প্রশ্ন, আগুন লাগানোর ঘটনাটি ঘটে ২৬ এপ্রিল। শুরু থেকেই স্থানীয় প্রশাসন এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল। স্থানীয় পুলিশ ঘটনার সত্যতা আমলে নিয়ে ইতোমধ্যে লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজের ২ জন কর্মচারীকে গ্রেপ্তারও করেছে। তারপরও ক্ষতিগ্রস্ত ও অভুক্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে ১৩ দিন সময় লাগল কেন?

গত ২০ মার্চ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূমি দখলের প্রতিবাদে এই ৩টি পাড়ার বাসিন্দারা বান্দরবান জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ওই সমাবেশে লাংকম পাড়ার কারবারি (প্রধান) লাংকম ম্রো অভিযোগ করেছিলেন, 'লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক কামাল উদ্দিন কয়েকজন স্থানীয়ের সহায়তায় আমাদের প্রায় ৩০০ একর জুম ভূমি দখল করেছে। প্রতিবাদ করতে চাইলে বিভিন্ন সময় আমাদের বিরুদ্ধে এই কোম্পানি মামলা করে। … তারা আমাদের আম, কলা, আনারস, বাঁশ বাগান কেটে দিয়েছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অনেকবার জানিয়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের আর্তনাদ শোনে না।' ২০১৯ সালেও ভূমি দখলের প্রতিবাদ করায় রাবার কোম্পানি ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে বলে জানান লাংকম ম্রো। মামলায় তাকেও আসামি করা হয়। বিক্ষোভকারীরা দখল হয়ে যাওয়া জুমের বাগান, পাহাড় এবং ভূমি ফেরত পাওয়ার আশায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন। এর একমাস পরেই আগুন লাগানোর ঘটনাটি ঘটে। এই দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা ভূমি দস্যুতার বিরুদ্ধে সরকার বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল?

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত জুম বাগান। ৪ মে, ২০২২। ছবি: দ্য ডেইলি স্টার

ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়ার জুমের বাগানে আগুন লাগানো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? জঙ্গল পরিষ্কার, রাবার চাষ, পর্যটন ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এর আগেও জুমের বাগানে আগুন লাগানো হয়েছে; দখল করা হয়েছে জুম ভূমি, উচ্ছেদ করা হয়েছে স্থানীয় পাহাড়িদের। করোনা মহামারির মধ্যেও হাজার হাজার পাহাড়িদের জীবিকা উচ্ছেদ করে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক তৈরি প্রচেষ্টার নির্মম প্রহসনও আমরা দেখেছি। ২০২০ সালের নভেম্বরে বান্দরবনের চিম্বুক পাহাড়ে 'ম্যারিয়ট-চন্দ্রপাহাড় রিসোর্ট অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক' নির্মাণ প্রকল্পের ফলে ম্রো সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ হাজার মানুষের ভিটেমাটি এবং জুম ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছিল। ম্রোদের ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও তাদের আন্দোলনে দেশজুড়ে সচেতন নাগরিকদের সমর্থনের ফলে ওই প্রকল্প স্থগিত হয়।

ত্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া একজন পাড়া প্রতিনিধি বলেছেন, 'না খেয়ে মরলেও যারা আগুন দিয়েছে তাদের হাত থেকে ত্রাণ নেব না।' খবরে প্রকাশ, ত্রাণ বিতরণ কাজে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন দেখে পাড়াবাসী ত্রাণ নেননি। লামা রাবারের কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার পরও তারা ত্রাণ নেয়নি। উল্টো, প্রথমে যে কয়েকটি পরিবার ত্রাণ নিয়েছিল তারাও ত্রাণের জিনিস ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু কেন? এরই প্রেক্ষিতে মনে পড়ছে ২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরাও সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেই উচ্ছেদ অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামের তিন সাঁওতাল নিহত হন। দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও আজ পর্যন্ত যথাযথ বিচার হয়নি। লামায় আগুন লাগানোর আগের দিনও গারোদের বংশানুক্রমে ভোগ করা জমিতে বন বিভাগের লেক খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলে গারো জনগোষ্ঠী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট ঘোষণা দেন 'উন্নয়নের নামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি কেড়ে নেওয়ার জন্যই সরকারের বন বিভাগ এ উদ্যোগ নিয়েছে।' এই ঘটনাগুলো কি প্রশাসনের প্রতি ভুক্তভোগী মানুষের অনাস্থার প্রকাশ নয়? পাহাড়ে কিংবা সমতলে এই আস্থাহীনতা কি দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে না?

দখল হয়ে যাওয়া জুমের বাগান, পাহাড় এবং ভূমি ফেরতের দাবিতে বান্দরবান জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন । ২০ মার্চ, ২০২২। ছবি: দ্য ডেইলি স্টার

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংকটের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত তাদের জন্য অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে পর্যাপ্ত ত্রাণ পাঠানো। পাশাপাশি পুরো ঘটনার একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ওই এলাকায় স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করে রাবার চাষের আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। সর্বোপরি, পাহাড়িদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে গোষ্ঠী ও ব্যবসায়িক স্বার্থে পরিচালিত তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।

ম্রো ও ত্রিপুরা ভাইবোনদের স্যালুট জানাই। দয়া ভিক্ষা নয়, প্রতিবাদেই হোক অন্যায়ের প্রতিরোধ।

সামসুদ্দোজা সাজেন: সাংবাদিক ও গবেষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Election Roadmap: BNP unhappy as Yunus gives no specific timeline

The election must be held by December, as any delay could cause the situation to spiral out of control, the BNP said after a meeting with the chief adviser yesterday.

8h ago