জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষায় মনোনিবেশ করছি না, পিছিয়ে পড়ছি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে

সম্প্রতি একদল শিক্ষার্থীর হামলার শিকার হয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ। গত ২২ মে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ডিগ্রি পরীক্ষায় অটোপাসের দাবিতে আন্দোলনরত একদল শিক্ষার্থী তার ওপর এই হামলা চালিয়েছে।
করোনা মহামারি ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই শিক্ষার্থীদের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে 'গ্রেস মার্ক' দিয়েছে। তারপরও তাদের পরীক্ষা এতই খারাপ হয়েছে যে, পাস নম্বরও পায়নি। তাদের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করার সুযোগও দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের ওপর হামলা চালিয়েছেন, যাতে তিনি ভয়ে তাদের দাবি মেনে নেন।
এই কলাম লেখা পর্যন্ত হামলায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি।
গণঅভ্যুত্থানের পরপরই গত বছর আগস্টে সচিবালয় সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের একই ধরনের 'অটোপাস'র দাবি তুলতে দেখা গেছে।
গত ১৬ মে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার কারণে ক্লাস, টিউটোরিয়াল ও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে—ফলে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।
গণঅভ্যুত্থানের পর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয় পদত্যাগ করেছেন, না হয় ৫ আগস্টের পর তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য।
তাদের উত্তরসূরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্য রাজনৈতিক ধারা থেকে। নতুন ৪৭ জন উপাচার্যের মধ্যে প্রায় ৩০ জনেরই সম্পৃক্ততা রয়েছে বিএনপি বা জামায়াতপন্থী শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে।
কাজেই, আমরা যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, সেটা কেবল হাত বদলের, পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন নয়।
৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন রাজনীতিবিদদের মতো পালিয়ে গেছেন? তারা কি একাডেমিকভাবে এতটাই যোগ্যতাহীন ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়া ছিলেন যে, দেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হতে তাদের একমাত্র বিকল্প ছিল তোষামোদ করা?
রূঢ় বাস্তবতা হলো, সব না হলেও বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়।
শেখ হাসিনা প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ করেছেন। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনীতিকরণ, বিশেষ করে উপাচার্যের পদ।
শিক্ষকরা যখন থেকে দেখলেন, একাডেমিক পেপার লেখা, মৌলিক গবেষণা করা, একাডেমিক মান বজায় রাখা, সৃজনশীল মনের বিকাশের জন্য উন্মুক্ত একাডেমিক পরিবেশ তৈরি করার পরও তাদের পেশাগত উন্নতির পথ তৈরি হয় না—তখনই সমস্যার শুরু হয়।
তারা স্পষ্ট বাস্তবতায় দেখতে পেয়েছেন, বিদেশি স্কলারশিপ পাওয়া, উচ্চপদ এবং দুঃখজনকভাবে উপাচার্য হওয়ার সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হলো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। আর শিক্ষকরা যখন থেকে এই পথে হাঁটতে শুরু করলেন, তখন থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভগ্নদশা শুরু।
একাডেমিক কাজে সফল হওয়া বেশি পরিশ্রমের এবং তার তুলনায় স্লোগান দেওয়া খুবই সহজ। কাজেই সেখানেও প্রতিযোগিতা জমে ওঠে। তখন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করেন একদল শিক্ষক। কারণ, হাসিনা সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং উপাচার্য হওয়াটাই ছিল ওইসব শিক্ষকদের প্রধান লক্ষ্য।
সব শিক্ষক নৈতিকভাবে এমন দেউলিয়া নন। আমরা অনেক শিক্ষককে মাথা উঁচু করে রাখতে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে, নিজের ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে এবং একাডেমিক মর্যাদা রক্ষা করতে দেখেছি।
যেসব শিক্ষক রাজনৈতিক পুরস্কার হিসেবে উপাচার্য পদ পেয়েছেন, তাদের প্রশাসনিক মান কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি এর প্রতিফলন দেখা গেছে নিয়োগ, পদোন্নতি, দায়িত্ব বণ্টন ও বিদেশ সফরে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে যে যৎসামান্য গবেষণা অনুদান দেওয়া হয়, সেটাও একইভাবে বিতরণ হয়েছে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা—সবাই নন—দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়া পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হন।
এর ফলে একাডেমিক জগতের দুর্নীতি আমাদের প্রতিটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে নিম্নমুখী করেছে। যার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ঢাবি উপাচার্য (২০১৭-২০২৩) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি একবার বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ১০ টাকায় এককাপ চা, একটি সমুচা, একটি সিঙ্গারা ও একটি চপ পাওয়া যায়। এই মন্তব্যই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান সম্পর্কে তার ধারণার পরিচয় বহন করে।
আমরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতির কথাই বলেছি, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হওয়ার কথা ছিল। কারণ এই সরকারে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি রয়েছে।
অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও একই, কিংবা আরও খারাপ।
একটি স্বনামধন্য বালিকা বিদ্যালয়ের ঘটনা বলি। পরীক্ষার সময় দুই শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোন ব্যবহার করে নকল করতে দেখেন এক শিক্ষক। তিনি তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করে উত্তরপত্র বাতিল করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা কয়েকজন মিলে আন্দোলন শুরু করে এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বাধ্য হয়ে কঠিন অবস্থানে না গিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন একই অবস্থা। শিক্ষকরাও ক্লাসে এসে তোতাপাখির মতো কিছু লেকচার দিয়ে চলে যান। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার স্বাভাবিক কথোপকথন বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতা প্রায় উধাও হয়ে গেছে। এর পেছনে আবার এই ভয়ও কাজ করে যে, আলাপচারিতার কোনো অংশ ওই সময়ের আলোচনার ভূমিকা ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে দেওয়া হতে পারে, যা ভিন্ন রকম বার্তা ছড়াতে পারে।
শিক্ষার্থীরা ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিল স্বৈরাচারী সরকার হঠাতে। সেই সরকারের পতন হয়েছে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে ১০ মাসের বেশি সময়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখনো পুরোপুরি ক্লাসে ফেরেনি।
কেউ কি তাদের ফিরতে বলেছে? কোনো উপদেষ্টা, কোনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা কোনো ছাত্রনেতা বলেননি যে তারা যা অর্জন করেছে তা অতুলনীয় এবং পুরো জাতি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ; কিন্তু তাদের ও দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জ্ঞানের ওপর এবং সেইসঙ্গে অর্জিত সেই জ্ঞান উদ্ভাবন ও উদ্যোগে কাজে লাগানোর ওপর। সেই বার্তা কোথায়? গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে পরিবর্তন আমরা দেখতে চাই, তার জন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ফিরতে হবে পড়াশোনায়।
আমরা যখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং সম্প্রতি ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশের সাফল্যের কথা বলি, তখন প্রধানত তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকেই নজর দেই। কিন্তু, শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে সেটা নিয়ে আমরা কখনোই আলোচনা করি না, বা করলেও সেটা খুবই যৎসামান্য।
এসব দেশ তাদের যুবসমাজকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে এবং সফল করতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশে একদল চীনা তরুণ গবেষকের 'ডিপসিক' উদ্ভাবন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়া বিস্মিত করেছে পুরো বিশ্বকে। এটা কি কাকতালীয়ভাবে হয়েছে? আমাদের এখানেও কি এমন কখনো হতে পারে? অবশ্যই পারে। কিন্তু তার জন্য আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে এবং সেগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে।
রূপকথার মতো শোনালেও এটা সত্য যে, ষাটের দশকের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ীরা পূর্ব পাকিস্তানে আসতো টেক্সটাইল ও স্টিল শিল্প সম্পর্কে জানতে—বিশেষ করে জাপানিদের প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের কোবে স্টিল কমপ্লেক্স থেকে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
আমরা অনেকবার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছি, বহুবার পাঠ্যক্রম সংশোধন করেছি, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি—কিন্তু তারপরও জাতিকে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা দিতে ব্যর্থ হয়েছি, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে।
এবার আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছি, কিন্তু শিক্ষা নিয়ে একটিও নেই। এখান থেকেই প্রতীয়মান হয়, আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক কোথায়।
একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে শিক্ষাবিহীন ভবিষ্যৎ নেই। সেটাও পুরোনো ধাঁচের নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সমন্বিত আধুনিক শিক্ষা হতে হবে।
নতুন এক বিশ্ব আমাদের অপেক্ষায়। আমরা কি তার অংশ হবো, নাকি কেবল দর্শকের ভূমিকায় থাকব?
কেবল কথার ফুলঝুরি দিয়ে নয়, বরং বাস্তব, সুপরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই পরিবর্তন আসতে পারে। আসুন, আমরা স্লোগানের দুনিয়া থেকে বের হয়ে নতুন বিশ্বের সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাই।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments