আনিসুজ্জামান ও সংবিধানের ভাষা 

আনিসুজ্জামানের জীবনে শ্রেষ্ঠ কাজ হলো বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব প্রদান। এ কাজের যোগ্য স্বীকৃতি আজও তাকে দেওয়া হয়নি। আসছে নভেম্বরে সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি হবে। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় দলিলের ভাষানির্মাণ কাজে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা বহুবছর প্রেরণা যোগাবে। হাজার বছরের বাঙালি জাতি প্রথম তার পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিল একাত্তরে। এরপর যখন সংবিধান রচনায় সময় এলো, তখন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণ আনিসুজ্জামানের সামনে তার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কাজের সুযোগ এসে ধরা দিয়েছিল। তিনি তার উপর অর্পিত সেই দায়িত্ব অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। তবে, কাজটি কঠিন ছিল। কেননা তখন পর্যন্ত বাংলায় সংবিধান লেখার কোন নমুনা তার সামনে ছিল না।

আনিসুজ্জামানের জীবনে শ্রেষ্ঠ কাজ হলো বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব প্রদান। এ কাজের যোগ্য স্বীকৃতি আজও তাকে দেওয়া হয়নি। আসছে নভেম্বরে সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি হবে। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় দলিলের ভাষানির্মাণ কাজে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা বহুবছর প্রেরণা যোগাবে। হাজার বছরের বাঙালি জাতি প্রথম তার পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিল একাত্তরে। এরপর যখন সংবিধান রচনায় সময় এলো, তখন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণ আনিসুজ্জামানের সামনে তার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কাজের সুযোগ এসে ধরা দিয়েছিল। তিনি তার উপর অর্পিত সেই দায়িত্ব অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। তবে, কাজটি কঠিন ছিল। কেননা তখন পর্যন্ত বাংলায় সংবিধান লেখার কোন নমুনা তার সামনে ছিল না।

বাঙালি জাতি ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। ফলে, নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তারা তাদের মুখ্য রাজনৈতিক দলিল নিজ ভাষায় প্রণয়ন করবে এটিই প্রত্যাশিত ছিল। তবে, বাহাত্তরের সংবিধান মূলত কোন ভাষায় প্রণয়ন করা হয়েছে এ নিয়ে একটি বিতর্ক চালু আছে। সংবিধান বিলের মুসাবিদা ইংরেজিতে হয় এবং এ ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের টেকনিক্যাল ড্রাফটসম্যানের সাহায্যও নেওয়া হয়েছিল। তবে গণপরিষদে সংবিধান বিল বাংলায় পেশ করা হয়। খসড়া সংবিধানের সঙ্গে যে ৬ জন গণপরিষদ সদস্য দ্বিমত পোষণ করেন, তারা সবাই ইংরেজিতে তাদের বক্তব্য পেশ করেছিলেন। 

গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'অনেকে এখন বলেন, সংবিধান প্রথমে ইংরেজি করে পরে বাংলা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ড্রাফটগুলো শুধু ইংরেজিতে করা হয়েছে। কারণ তখন পর্যন্ত আইনের সব কিছুই ইংরেজিতে লেখা। কিন্তু সংবিধান লেখা হয়েছে বাংলায়। ইংরেজি করা হয়েছে বাংলা থেকে। আমরা ইংরেজিতে টেক্সটগুলো নিয়েছি, ড. আনিসুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গে সেটা বাংলা করেছেন। বাংলার সঙ্গে ইংরেজির অনুবাদ ঠিক আছে কিনা, তা মেলানোর জন্য আমরা ড. মযহারুল ইসলাম ও সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে কাজ করেছি'–তারকালোক, পাক্ষিক পত্রিকা।

এ বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামান তার এক প্রবন্ধে বলেন, 'কামাল হোসেন খসড়া তৈরি করে যাচ্ছিলেন, আর আমরা অনুবাদ করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষ্যের প্রয়োজনে কামাল তার ইংরেজি বাক্য বা তার বিন্যাসে পরিবর্তন করতেন।'

সংবিধানের ভাষা বিষয়ে গণপরিষদেও অনেক আলোচনা হয়েছে। স্পিকার শব্দের বাংলা করা হয়েছিল অধ্যক্ষ। কিন্তু স্পিকার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে কেউ অধ্যক্ষ শব্দটি মেনে নিতে চাননি। একজন বলেন, ওতে মফস্বলের কলেজের অধ্যক্ষ মনে হয়। তিনি নিজেই মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তুমুল হাস্যরোল আর করতালির মধ্যে দিয়ে তার কথা প্রায় সকলেই অনুমোদন করেছিলেন। 

গণপরিষণদের বাইরেও সংবিধানের ভাষা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেফাকে এ বিষয়ে একটি কলাম লিখেছিলেন। তিনি মনে করেন, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কনসেপ্টটাই পাশ্চাত্যের, তাই ইংরেজি পরিভাষা ব্যবহার করলে দোষ হতো না, বরং জাতীয় সংসদ না বলে পার্লামেন্ট কিংবা রাষ্ট্রপতি না বলে প্রেসিডেন্ট  লেখাই উচিত ছিল। তার রচনার নাম ছিল 'সংবিধানের বাংলা মুসাবিদায় পরিভাষার উৎপাত'–ইত্তেফাক, ২০ অক্টোবর ১৯৭২। এ বিষয়ে আনিসুজ্জামানের মত হলো, 'আমরা যতদূর পারি, একই ইংরেজি শব্দের জন্যে একই বাংলা শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী অবশ্য ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।'

আনিসুজ্জামান আরও বলেন, 'আমাদের সামনে বাংলায় লেখা সংবিধানের কোনো আদর্শ ছিল না। আমরা যারা বাংলা ভাষ্যরচনার কাজ করেছিলাম, তাদের কোনো সংবিধান বা আইন বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কামাল হোসেন আইনের যে ব্যাখ্যা করে দিতেন, তা-ই বাংলা ভাষ্য প্রণয়নে আমাদের সহায় ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি একটি ইংরেজি শব্দের জন্যে একটি বাংলা শব্দই ব্যবহার করতে, তবে সর্বত্র তা রক্ষা করতে পারিনি। অনেক সময়ে একাধিক ইংরেজি শব্দের একটি বাংলা প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় প্রচলিত আছে : control নিয়ন্ত্রণ, regulation- নিয়ন্ত্রণ; এখানে দুটিরই বাংলা এক। হয়তো প্রথমটা "নিয়ন্ত্রণ" রেখে দ্বিতীয়টা "নিয়মন" করা যেত, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ যত সহজে বোঝা যায়, নিয়মনে তা হতো না। distribution ও allotment  উভয়ক্ষেত্রেই আমরা বণ্টন বলেছি; প্রথমটা "বিতরণ" হতে পারত, কিন্তু "উৎপাদনন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন-প্রণালীসমূহের মালিক হইবে জনগণ"—এই বাক্যাংশে বিতরণের চেয়ে বণ্টনই, মনে হয়, বেশি উপযুক্ত হয়েছে।'

এ বিষয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও লেখক মওদুদ আহমদ মন্তব্য করেন যে, 'বাংলাদেশের সংবিধান originally কিন্তু বাংলায় হয় নি, কিন্তু বাংলাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। Originally it was drafted in English। ইংরেজিটাকে বাংলা করে বাংলাটার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং interpretation-এ বলা হয়েছে "বাংলা অগ্রাধিকার পাবে"। কিন্তু আসলে লেখা হয়েছে ইংরেজিতে'–পৃ.৩৪, সংসদে যা বলেছি, ইউপিএল। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হিসেবে প্রদত্ত বক্তৃতা।

সংবিধানের বাংলা পাঠে কোনো ত্রুটি নেই- এটি বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আনিসুজ্জামানও মনে করতেন, 'আমরা যে ভুল করিনি, তাও হয়তো নয়। একটি ক্ষেত্রে প্রায় জ্ঞাতসারেই ভুল করেছি। পাঠ্যপুস্তকে unitary শব্দের প্রচলিত বাংলা ছিল এককেন্দ্রিক; ১৯৭২ সালে কেন্দ্র শব্দটি আমার মনে এমনই অরুচির সৃষ্টি করেছিল যে, আমি "এককেন্দ্রিক" না লিখে একক ব্যবহার করেছিলাম, যদিও "একক" যে unit-এর বাংলা, তা আমার জানা ছিল না। আতাউর রহমান কায়সার এই অসংগতির দিকে আমার দৃষ্টি প্রথম আকর্ষণ করেন; পরে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লেখেন যে, শব্দটা "একরাজ্য" হতে পারত। বাস্তবিকই তাই, কিন্তু একরাজ্য শব্দের প্রয়োগ তখন পর্যন্ত আমি দেখেনি।'

নিজের ত্রুটি স্বীকার করে তিনি বলেন, 'প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মনে করেন প্রথম অনুচ্ছেদে Unitary অর্থে "একক" শব্দ যথার্থ হয়নি। আমরা "একক" অর্থে অদ্বিতীয়, একাকী বা সংখ্যার দক্ষিণ দিকের প্রথম অঙ্ক বা পরিমাপের মাত্রা বুঝি। একাধিক স্টেট এর সমন্বয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠিত। ফেডারেল রাষ্ট্রের স্টেটকে আমরা অঙ্গরাজ্য বলি। ইউনিটারি রাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্য নেই, সমগ্র দেশ মিলে একটি রাজন্যক্ষেত্র। সেদিক থেকে Unitary শব্দের বাংলা "একরাজ্য" হতে পারত। "বাংলাদেশ একটি একরাজ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র" এই শব্দগুলো কানে বাধে না এবং তাৎপর্য বুঝতেও আমরা ক্লিষ্ট হই না'–ড. আনিসুজ্জামান, বাংলাদেশের সংবিধান ও তার বাংলা ভাষ্য।

২.

এ বছর বাংলাদেশ সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি হবে। এ যাবৎ বেশ কয়েকটি মামলায় সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে সাংঘর্ষিক বিষয় আছে কিনা তা আলোচিত হয়েছে। উচ্চ আদালতে সেসব ব্যাখ্যা এখন সংবিধানের বাংলা পাঠের পক্ষে সব রায় হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের দুটো রায়ে বাংলা পাঠকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ওসমান গনি বনাম মৈনুদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য মামলায় (২৭নং ডিএলআর, আপিল বিভাগ, পৃ.৬১) তৎকালীন বাংলাদেশ হাইকোর্ট ও পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্ট রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের সময়সীমা প্রসঙ্গে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের সপ্তম অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মন্তব্য করেন, 'Indeed, whatever ambiguity the English version may be said to contain there appears none in the Bengali version'। সংবিধানের ১৫৩ নং অনুচ্ছেদের (৩) নং দফা উল্লেখ করে আপিল বিভাগ রায় দেন যে, আইন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সংবিধানের বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে।

ফজলুল হক চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ (৩০ নং ডিএলআর, হাইকোর্ট, পৃ. ১৪৪) মামলায় ১৫৩ নং অনুচ্ছেদের (২) নং দফায় বাংলা ও ইংরেজি পাঠে বিরোধের প্রশ্ন উঠেছিল। এই রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। প্রজাতন্ত্রের কর্মে অসামরিক পদে নিযুক্ত কোন ব্যক্তিকে বরখাস্ত, অপসারিত ও পদাবনমিত করার ক্ষেত্রে ১৩৫ নং অনুচ্ছেদের (২) নং দফায় বর্ণিত রয়েছে, 'অনুরূপ পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাঁহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসংগত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাঁহাকে বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না'। এই বিধানের ইংরেজি পাঠ নিম্নরূপ, 'No such person shall be dismissed or removed or reduced in rank until he has been given a reasonable opportunity of showing cause why that action should not be taken'।  বাংলা পাঠে আছে 'প্রস্তাবিত ব্যবস্থা' কিন্তু ইংরেজি পাঠে কেবল that action কথা থাকায় বিরোধের প্রশ্ন উঠে। হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, 'দুই পাঠে কোন বিরোধ নেই এবং যদি বিরোধ থাকে তবে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে'।

আমাদের সংবিধানের বাংলা টেক্সটে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যেমন : অ্যাক্ট, অ্যাটর্নি জেনারেল, আপিল, এজেন্ট, অ্যাডভোকেট, অ্যাডহক কমিটি, কমিশন, কমিশনার, কোরাম, কোর্ট, কোর্ট-অফ-রেকর্ড, গেজেট, গ্যারান্টি, জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ট্রাইবুনাল, ডেপুটি স্পিকার, নোটিশ, পিও, ফি, বিল, বেঞ্চ, ব্যাংক, ম্যাজিস্ট্রেট, রিপোর্ট লাইসেন্স, শিপিং কর্পোরেশন, শেয়ার সার্টিফিকেট, সার্ভিসেস স্ক্রিনিং, সিকিউরিটি, সুপ্রিম জুডিসিয়্যাল কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট, স্টক, স্ট্যাম্প, স্পিকার, হাইকোর্ট। আইন আদালতে বহুল প্রচলিত এই শব্দগুলো জোর করে বাংলা না করে আনিসুজ্জামান সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোদ ইংরেজি ভাষার ভাগ্যেও এই ঘটনা ঘটেছিল। ইংল্যান্ডে ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজা তৃতীয় অ্যাডওয়ার্ড আদালতের ভাষা হিসাবে ল্যাটিনের বদলে ইংরেজি ব্যবহারের প্রচলন করেন। আজও ইংল্যান্ডের আদালতে ও আইন চর্চায় বহু ল্যাটিন ও নরম্যান ফ্রেঞ্চ শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। কেননা এর আগে বহু প্রতিষ্ঠিত ল্যাটিন শব্দ ইংরেজিতে আত্মীকরণ করা হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে ল্যাটিনের জায়গায় ইংরেজি।

এছাড়া, ভাষার ও শব্দ গঠনের বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকক্ষেত্রে একই বিষয়ে একাধিক শব্দের ব্যবহার তিনি করেছেন। অর্থাৎ সংবিধানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের একাধিক বাংলা এবং বাংলার একাধিক ইংরেজি শব্দ দেওয়া হয়েছে। যেমন-

revoke অর্থে রদ (১৩৬) ও প্রত্যাহার [১৪১ (ক)] 

repeal অর্থে বাতিল [৯৩ (২)], [৪৭ (২)] ও রহিত [৯৩ (১)] 

বাতিল অর্থে void [৪৭ (২)], ২৬ (১) ও ২৬ (২)] ও [৯৩ (২)]

নিয়ন্ত্রণ অর্থে control ও regulation [৪৭ (ক) (গ)]

মনোনয়ন অর্থে nominate [১০০ (৪)] ও selection [১৪০ (১) (ক)] 

নির্দিষ্ট অর্থে assign [১০০ (৪)], কিন্তু নির্দিষ্টকরণ অর্থে appropriation [৯০ (১)]

বণ্টন অর্থে distribution [১৩] ও allotment [১২৫ (ক)] 

আইনে দ্বারা নির্ধারিত অর্থে preseribed by law [১৪০ (গ)] Determined by Law [৫(২)], (৬(১)] 

পেশ করা হবে অর্থে shall be submitted (১৪৫) (ক)], (১৩২), ও cause to be laid [১৫৩]

হানি না করে ও হানি না ঘটিয়ে উভয় অর্থে without prejudice ১২৮ [(২), ৫২ (১)]

ক্ষমতা ও কার্যকরতা, এবং ক্ষমতা ও সক্রিয়তা উভয় অর্থে force and effect [চতুর্থ তফসিলে ৬ (৩) ও ৬ (৪)], ইত্যাদি।

এগুলো কোন ত্রুটি বা দুর্বলতা নয় বরং বিষয় ও ভাব প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে শব্দের বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহারের কারণে এরকম ঘটে থাকে। উপরের এই উদাহরণটি দেখলেও বুঝা যায়, সংবিধানের মতো সর্বোচ্চ একটি আইনের বাংলা পাঠ প্রণয়ন কত কঠিন ছিল। কেননা অপরাপর গদ্য ভাষার মতো বর্ণনামূলক হলেও আইনের ভাষায় এক ধরনের সুনির্দিষ্টতার অবশ্যকতা রয়েছে। যা প্রায়ই গাণিতিক সুনির্দিষ্টতার কাছাকাছি, এবং সংবিধানের ভাষার ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান এই কাজটি করেছেন অনন্য দক্ষতার সঙ্গে।

সংবিধানের বাংলা পাঠের জন্য আমরা যেমন আনিসুজ্জামানের কাছে কৃতজ্ঞ, তেমনি এর ইংরেজি পাঠের পরিশীলনের জন্য আমরা আরেক বিদেশির কাছেও কৃতজ্ঞ। ড. কামাল হোসেন সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো ইংরেজিতে লিখেছিলেন। তখন ইংরেজি ভাষায় দক্ষ পেশাদার ড্রাফটসম্যানের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লন্ডনে অবস্থিত কমনওয়েলথ্ সচিবালয়কে অনুরোধ করা হলে তারা সাড়া দেন। তারা গাথরি নামের একজন চৌকস ড্রাফটসম্যানকে বাংলাদেশে পাঠান। আনিসুজ্জামান বলেছেন, 'ওই ব্যক্তির নাম খুব সম্ভবত জন গাথরি। প্রায় পাঁচ মাস ঢাকায় ছিলেন। আমাদের দেশে বেসরকারি বিলের তেমন মূল্য নেই। কিন্তু হাউস অব কমনস্-এর উল্লেখযোগ্য বিল বেসরকারি হিসেবে আসে। সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয় এবং মাঝেমধ্যে আইনেও পরিণত হয়। হাউস অব কমনস্-এ উত্থাপনের জন্য বেসরকারি বিল তৈরির কাজে সহায়তা করে লন্ডনের বিভিন্ন ল ফার্ম। জন গাথরি এ ধরনের বেসরকারি বিল তৈরির কাজে নিয়োজিত ল ফার্মে কাজ করতেন এবং আইনের খসড়া তৈরিতে ঈর্ষনীয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন'–মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলো।

সংবিধানের বাংলা পাঠ প্রণয়নের মাধ্যমে আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষায় আইন তৈরির একটি মান বা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। সংবিধানের লেখ্য বাংলার ক্ষেত্রে তিনি যে সাধুরীতি অবলম্বন করেছেন তাও যথার্থ হয়েছে। কেননা, সংবিধানের মতো একটি পরম ও গাম্ভীর্যপূর্ণ দলিলের জন্য ধ্রুপদী সাধুরীতির অবলম্বন, এর ভাব প্রকাশে সহায়ক হয়েছে।

তার অবদানের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। 

 

আরিফ খান: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago