আমাদের আলোর পথযাত্রী পলান সরকার

ধরুন আমরা যদি বইয়ের মালিক হই আর কেউ আমাদের কাছে বই ধার চায় তবে আমাদের মনের অবস্থাটা প্রথমত কেমন হয়? যেমনই হোক একটি জিনিস ঠিকই পড়ে, তা হলো কপালে প্রথমেই খানিকটা চিন্তার ভাঁজ। মূলত সেই ভাঁজ ‘বইটি আদৌ ফেরত আসবে তো!’ সেই চিন্তা থেকে।
পলান সরকার। ছবি: সংগৃহীত

ধরুন আমরা যদি বইয়ের মালিক হই আর কেউ আমাদের কাছে বই ধার চায় তবে আমাদের মনের অবস্থাটা প্রথমত কেমন হয়? যেমনই হোক একটি জিনিস ঠিকই পড়ে, তা হলো কপালে প্রথমেই খানিকটা চিন্তার ভাঁজ। মূলত সেই ভাঁজ 'বইটি আদৌ ফেরত আসবে তো!' সেই চিন্তা থেকে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর 'বই কেনা' প্রবন্ধে ফিরে যাই। যেখানে মুজতবা আলী লিখেছিলেন মার্ক টোয়েনের সাম্রাজ্যের কথা। তবে সেই সাম্রাজ্য বইয়ের সাম্রাজ্য অর্থাৎ লাইব্রেরির। মুজতবা আলী বর্ণনা করেছিলেন এমনই, 'মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরীখানা নাকি দেখবার মতো ছিল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই, বই আর শুধু বই। এমন কি কার্পেটের উপরও গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকত-পা ফেলা ভাঁড়। এক বন্ধু তাই মার্ক টোয়েনকে বললেন, 'বইগুলো নষ্ট হচ্ছে; গোটা কয়েক শেলফ যোগাড় করছ না কেন?' মার্ক টোয়েন খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললেন, 'ভাই ঠিক বলেছ। কিন্তু লাইব্রেরিটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি শেলফ তো আর সে কায়দায় যোগাড় করতে পারি না। শেলফ তো আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার চাওয়া যায় না।'

আসলেই সত্যি। যে বই একবার যায় তা চিরতরে বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অত্যধিক। তবে ছিলেন একজন ব্যতিক্রম। তার সে ধাত ছিল না। যিনি কেবল অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার এক পথিক।

নাটোরের বাগাতিপাড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার। সময়টা গত শতাব্দীর বিশের দশক। পারিবারিকভাবে তার নাম রাখা হয় হারেজ উদ্দিন সরকার। মা অবশ্য ডাক নামটা রেখেছিলেন 'পলান'। জন্মের পাঁচ মাস পরেই বাবাকে হারান পলান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আর্থিক অনটনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা। কিন্তু মানতে পারেননি কেবল তার নানা ময়েজ উদ্দিন। নানার অনড় মনোভাব। আর যাই হোক আর্থিক অনটনে বন্ধ হতে পারেনা পলানের পড়াশোনা। নাতিকে নিজের বাড়ি বাউশা গ্রামে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করালেও সেই স্কুলে প্রাইমারির বেশি পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় সেখানেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি হয়। নানা স্থানীয় জোতদার হওয়ায় জোতদারির খাজনা আদায় করতেন পলান। নানার মৃত্যু হলে বিশাল ভূসম্পত্তির একাংশও জুটেছিল তার ভাগে। তার বইপ্রেমটা আরও পরের। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ইউনিয়নের কর আদায় করতেন তিনি। সেখান থেকে নেশা হলো যাত্রার। যাত্রাদলের সঙ্গে ঘুরতে হতো গ্রাম থেকে গ্রামে, চর থেকে চরে, গঞ্জ থেকে গঞ্জে। কখনো মঞ্চের পেছনে যাত্রার পাণ্ডুলিপি থেকে অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ পড়ে শোনানো, যাকে ইংরেজিতে বলে প্রম্পট। এই প্রম্পট বলতে গিয়েই বই পড়ার নেশায় জড়িয়ে গেলেন পলান সরকার।

এভাবেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিতেন পলান সরকার। ছবি: সংগৃহীত

বই তার সামনে খুলে দিলো এক নতুন দিগন্ত। সে সময় বাউশা ইউনিয়নে কোনো হাইস্কুল ছিল না। নিজে পড়াশোনা না করতে পারার মনোবেদনা আর যাতনা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল পলান সরকারের। হাইস্কুল নির্মাণে ৫২ শতাংশ জমি দিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। তাকে দেওয়া হলো বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্বও।

তখন তার একটাই ভাবনা 'কীভাবে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আরও আগ্রহী করা যায়?' একপর্যায়ে পেয়েও গেলেন সেই উপায়। স্কুলে যারা প্রতিবছর মেধাতালিকায় স্থান পাবে তাদের মধ্যে ১০ জন উপহার পাবে বই। এদিকে দেখা দিলো মধুর সমস্যা। বাকি শিক্ষার্থীদেরও বইয়ের আবদার। যখন তিনি দেখলেন এরাও পড়তে আগ্রহী। তিনি ঠিক করলেন বই দিবেন সবাইকে। যারা চায় সবাই পাবে, তবে শর্ত একটাই, পড়া শেষে ফেরত দিতে হবে বই।

তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা পয়সার বই পড়ার লোভ। গ্রামের মানুষেরাও জুটেছেন বইয়ের নেশায়। আর এর মধ্য দিয়ে জন্ম নিলো এক অসামান্য উদ্যোগের। নাম তার 'বই পড়া আন্দোলন।'

পলান সরকারের নিজের উপার্জনের সিংহভাগই যেত বইয়ের পেছনে। ১৯৯২ সালের একদিনের কথা। পলান সরকারের শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস। ডাক্তারের কড়া হুকুম, 'এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রতিদিন অন্তত তিন কিলোমিটার করে হাঁটতে হবে।'

যে পথটি ছিল বইপড়া আন্দোলনের। ছবি: সংগৃহীত

এই ডায়াবেটিসই যেন জীবনে শাপে বর হয়ে এলো পলান সরকারের। মাথায় এলো অভিনব চিন্তা। ঠিক করলেন তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়েই বিলি করবেন বই। যারা তার বাড়িতে এসে বই বিলি করত তাদের নিষেধ করে নিজেই গ্রামময় ঘুরে বই বিলি করতেন। আর পড়া শেষে ফিরিয়ে আনতেন বই।

একদিন তার মনে হলো। কেবল নিজের গ্রামেই সীমাবদ্ধ কেন! অন্য গ্রামগুলো কেন বঞ্চিত হবে বই থেকে। একে একে বাউশা গ্রাম ছাড়াও আশপাশের দিঘা, চকরপাড়া, টলটলিপাড়া, হাটপাড়া, মাঠপাড়া, ফতেপুর, অমরপুর, সরকার পাড়া, বেনুপুরসহ বাউশা ইউনিয়নের ১২টি গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে বই বিলি করতে লাগলেন পলান সরকার। এই গ্রামগুলোতে তার বিলি করা বইয়ের পাঠক সংখ্যাই ছিল হাজারের বেশি। ভোরবেলা ঝোলা কাঁধে বই নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিলি। দিনে দিনে জন্ম নিলো এক অবিস্মরণীয় বিপ্লবের। যে বিপ্লবের নাম বই পড়া বিপ্লব। কেবল বাড়ি বাড়ি বই বিলিই নয়। যেকোনো নিমন্ত্রণে তিনি উপহার হিসেবে দিতেন বই।

ইউনিয়নের সব স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের জন্য তার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে থাকত বই। তার চাল কলে হালখাতার সময় যারা বাকি পরিশোধ করতেন তাদের জন্যও বরাদ্দ থাকত একটি করে বই। ১৯৯২ সালে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গড়ে তোলা বই পড়া আন্দোলনকে পলান সরকার এগিয়ে নিয়েছেন তার জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত। গ্রামের মানুষের কাছে চিরন্তন এক দৃশ্য ছিল কাঁধে ঝোলা হাতে চলছেন এক মহামানব। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই যে দেখা মিলবে বইয়ের ঝোলা কাঁধে উঠোনে হাজির এক আলোর ফেরিওয়ালা। পুরো একটি জনপদে বইপড়াকে যিনি রূপ দিয়েছেন সমাজ বদলের আন্দোলন হিসেবে। বই পড়াকে যিনি রূপান্তরিত করেছে এক নিভৃতে গড়ে উঠা গণবিপ্লবে। যে বিপ্লব ছিল জ্ঞান বিতরণ ও মেধা জাগরণের।

বেঁচে থাকলে আজ ১০২ বছরে পা দিতেন পলান সরকার। শারীরিকভাবে হয়তো পলান সরকার নেই বাংলার বুকে। কিন্তু তার স্বপ্ন আর সুদূরপ্রসারী দিগন্ত পলান সরকারকে সমুজ্জ্বল করে রাখবে আজীবন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আমাদের আলোর দিশারীর প্রতি।

তথ্য সূত্র: 

১. পঞ্চতন্ত্র/ সৈয়দ মুজতবা আলী

২. বিনি পয়সায় বই বিলাই। প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭

[email protected]

Comments