আশাহীনতায় আমাদের সমাজ

আমাদের জীবনে আশা নিয়ে ঘুরে ফিরে আসে প্রতিটি নতুন বছর, নতুন মাস। মনে করা হয় যে, দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না এবং বদলায় না যে, সেই পুরাতন ও একঘেঁয়ে কাহিনীই নতুন করে বলতে হয়। না-বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হই নি।

কিন্তু মুক্তি যে আসে নি, তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যর্থতার স্মারকচিহ্নগুলো জ্বল জ্বল করছে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। তবে মাঝে মধ্যে দু'একটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি। পরস্পরকে বলি যে, আমরা তো ভালো নেই। কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি। 

সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা একটি অতি পুরাতন প্রশ্ন, কিন্তু তার আবির্ভাব নিত্যনতুন এবং অব্যাহত। প্রশ্নটার তো মীমাংসা হয়ে যাবার কথা। কেননা স্বাধীনতা এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন বস্তু এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র কল্পকাহিনী মাত্র। আমাদের এই 'গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রে জাতীয় সংসদের সদস্যদের দায়িত্ব হবার কথা আইন প্রণয়ন, সরকারের নির্বাহী অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন, সরকারকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, সরকারি নির্বাহী কার্যক্রমের স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা বিধান এবং রাষ্ট্রের বৈদেশিক চুক্তি ও পররাষ্ট্র নীতির ওপর তীক্ষ্ণ  দৃষ্টি রাখা। কিন্তু আমাদের সংসদে এসব কাজ যে সামান্য পরিমাণে করা হচ্ছে এমনটা বলবারও কোনো সুযোগ নেই।

সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার অন্তর্গত। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণি সমালোচনার স্পর্শ মাত্র সহ্য করতে প্রস্তুত নয়, এ ব্যাপারে তারা বড়ই স্পর্শকাতর। এর কারণ হচ্ছে, তারা নৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে নেই। এটা তাদের জানাই আছে তারা কি প্রকারে ক্ষমতায় এসেছে, এবং যখন ক্ষমতা তাদের কোনো অংশের একচ্ছত্র হয়ে পড়ে তখনো এটা তাদের অজানা থাকবার কথা নয় যে, জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। কারণ তারা নিজেদের স্বার্থই শুধু দেখে, জনগণের স্বার্থ নিয়ে মোটেই চিন্তা করে না। সমালোচনার আওয়াজ শুনলেই তারা ক্ষেপে ওঠে। ভাবে তাদের বুঝি পতন ঘটবে। 

ওদিকে এরা নিজেরা নানা ধরনের আওয়াজ তোলে। কেউ বলে দিনবদল ঘটিয়ে তবে ছাড়বে, কেউ বলে তাদের উন্নয়নের বন্যায় ভেসে লোকে আনন্দে নৃত্য করবে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা চায় সমালোচনার যে কোনো ধ্বনিকে স্তব্ধ করে দিতে। কেউ যদি প্রতিবাদী আওয়াজ তোলে তাহলে তার গলা চেপে ধরতে উদ্যত হয়। কণ্ঠরোধের এই কাজটাই তারা করতে চায়। যে জন্য সমালোচকদের ওপর বিষোদ্গার করাটা তাদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তাদের ভঙ্গিটা এই রকমের যে, আমরা যেহেতু রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পেয়ে গেছি তাই আওয়াজ যা দেবার আমরাই দেবো, অন্যরা তা শুনবে। এই সব ধ্বনি আবার আত্মপ্রবঞ্চনাও বটে। তারা নিজেরা ধ্বনি দেবে এবং সেই ধ্বনি সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হবে, এটাই তাদের কামনা। 

তবে সরকারি দল যে সব সময়ে এক গলায় কথা বলে তা নয়। ভিন্ন ভিন্ন স্বর ও সুর শোনা যায়। যেমন, বর্তমান দিনবদলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রীদের একজন বলেছিলেন যে, তারা দ্রব্যমূল্যকে কব্জার ভেতর নিয়ে আসতে পারবেন। কেননা সরকারি টিসিবি'কে তারা আবার চালু করবেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্য এক মন্ত্রী আওয়াজ দিয়েছেন, না, তা নয়, আমরা মুক্তবাজার চালু রাখবো। বাজারই দাম নামিয়ে আনবে। ফলে টিসিবি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে, এবং দাম মোটেই নামেনি। বরং ক্রমাগত বৃদ্ধিতে জনগণকে নাকাল করে ছাড়ছে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা থাকাটা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস বলছে, এখানে কোনো বিরোধী দলই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। সরকারপক্ষ থেকে বাধা এসেছে, বিরোধী দলের নিজেদের মধ্যেও সেই নৈতিক জোরটা দেখা যায়নি। যার ওপরে ভর করে রুখে দাঁড়াবে; তদুপরি জনগণের কাছে তাদের যে গ্রহণযোগ্যতা থাকে তাও নয়। এক্ষেত্রে সমালোচনা যেটুকু পাওয়া যায়, তা আসে জনগণের কাছ থেকেই। তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া আর একনায়কত্ব কায়েমের ভেতর বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না। 

দেশের জনমাধ্যমকে যখন সবাক ও নির্বাক উভয় প্রকারের হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে, তখন বর্তমান সরকারই আবার সংসদে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ পাশ করেছে। এই আইনের উদ্দেশ্য হবে জনমাধ্যমকে ক্ষমতাবান করা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনায়ন। এমন বৈপরীত্য আমাদের দেশের বহুক্ষেত্রেই দেখা যাবে, এক্ষেত্রেও যে দেখা যাচ্ছে সে আর বিচিত্র কী। এই আইন প্রণয়নের পেছনে অবশ্য তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ছিল। অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, সরকার যখন সমালোচনার যে কোনো ধ্বনিকেই অসহ্য মনে করে তখন এই আইন নামে থাকবে, কিন্তু জনগণের কোনো কল্যাণে আসবে না। 

শাসকশ্রেণি স্বেচ্ছায় জনগণকে ক্ষমতাবান করা দূরে থাক, তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কোনো রকম প্রকাশকেই সহ্য করছে না। সহ্য যাতে করে তার জন্য চাপ প্রয়োগ দরকার হবে। আর সেই চাপটা যে দু'টি জায়গা থেকে আসতে পারে তার একটি হচ্ছে, ওই জনগণ এবং অপরটি, যেটি আরো জরুরি, সেটি হলো বিকল্প গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ। দ্বিতীয়টি গড়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু প্রথমটি, অর্থাৎ জনগণ, দ্রুতই নিজেকে সংগঠিত করে তুলতে পারে যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হন।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে সাংবাদিকের ঐক্য পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, যে জন্য কোনো সংবাদপত্রের ওপর আঘাত এলে সারা দেশজুড়ে প্রতিবাদ উঠতো। সেই ঐক্যটা এখন আর নেই। শাসকশ্রেণি সাংবাদিক ও জনমাধ্যমের কর্মীদেরকে বিভক্ত করে ফেলেছে, আর এ জন্যই জনমাধ্যম এখন অতটা বিপন্ন। 

কোনোই সন্দেহ নেই যে, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা একটা বস্তুগত ভিতের ওপরই গড়ে ওঠে এবং নির্ভর করে। বাংলাদেশে বস্তুগত ওই ভিতটা শক্ত নয়। যে নতুন বছর আমরা শুরু করছি সে-বছর সেটি যে শক্ত হবে তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। মস্ত বড় সমস্যাটা হচ্ছে বিনিয়োগের। বিনিয়োগ বাড়ছে না। প্রবাসীদের কাছ থেকে যে অর্থ পাওয়া যায় তাও বৃদ্ধি না পেয়ে সঙ্কুচিত হবে এমনটাই আশঙ্কা। 

দেশে বড় বড় সব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে যাতে খরচ হবে প্রচুর। উৎপাদন তো ঘটবেই না, বরং অপচয় হবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। যেমন ঢাকা শহরের জন্য উড়ালপথ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এতে যানজট তো কমবেই না উল্টো বৃদ্ধি পাবে। পথচলাচলকারী সাধারণ মানুষ এবং জনপরিবহনযাত্রীদের সুবিধা নষ্ট হবে, সুযোগ যেটুকু বৃদ্ধি পাবার তা পাবে মোটরগাড়িওয়ালাদের। পৃথিবীর সকল বড় শহরেই উড়াল পথের ধারণা এখন পরিত্যক্ত। তবু বাংলাদেশে তার আয়োজন। যানজটের সমাধানের জন্য প্রয়োজন মেট্রোর, যে ব্যবস্থা সব বড় শহরে আছে, রয়েছে এমন কি কলকাতাতেও; ঢাকাতেও তার প্রয়োজন, আশার কথা উড়াল মেট্রোরেলের কার্যক্রম চলছে। শেষ হলে এবং চালু হলে বোঝা যাবে আমরা কী পরিমাণে উপকৃত হচ্ছি।

আমাদের সমষ্টিগত মুক্তির লক্ষ্যে বিদ্যমান ব্যবস্থাটা বদলানো আবশ্যিক। কিন্তু বদলানো যায়নি। যে জন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের, তারাও যে নিরাপদে রয়েছে তা নয়। আর বেশিরভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এই ব্যবস্থাকে যে বদলাতে পারবো না, তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। যা প্রয়োজন তা হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেটা না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারবো না এবং সবাই আধমরা হয়েই থাকবো, এখন যেমনটা রয়েছি। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

6h ago