একটি লেবু, সাবান, ভ্যাসলিন ও ইভিএমের গল্প

এ বছরের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (এনসিসি) নির্বাচনে বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রে ভোটের জন্য আদর্শ পরিবেশ দেখা যায়। ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য লম্বা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন। পোলিং এজেন্ট, কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি আয়োজন ছিল, যা সাধারণত দেখা যায় না--হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে নেওয়া স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে দেখা যায়, মানুষ শুধু তাদের বুড়ো আঙুল ধুচ্ছেন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নিজের পরিচয় যাচাই করতে এই আঙুলের প্রয়োজন পড়ে।

নারায়ণগঞ্জে দেখা গেল, ইভিএম অনেক মানুষের আঙুলের ছাপ পড়তে পারছে না, বিশেষ করে একটু বয়স্ক ভোটারদেরটা। যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছিল, তখনই তারা তাদের বুড়ো আঙুলে পেট্রোলিয়াম জেলি মাখছিলেন। পোলিং কর্মকর্তাদের টেবিলেও ভ্যাসেলিনের কৌটা রাখা ছিল। কেউ কেউ লোশন বা ফালি করে কাটা লেবুর টুকরাও ব্যবহার করছিলেন।

ইভিএম এ আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণের গতি কমে যায়। মেশিন ভোটারদের পরিচয় যাচাই করতে না পারায় অনেকে ভোটই দিতে পারেননি। এছাড়াও, এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা না থাকায় অনেক ভোটার বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে হতাশা প্রকাশ করেন। তবে তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। অপেক্ষাকৃত কম সময়ে তারা ভোট দিতে পেরেছেন।

ইভিএমের সমস্যা বাদ দিলে, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছিল অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। তবে মাত্র ৫ লাখ ভোটারের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আমি দেখেছি কীভাবে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যদি ১২ কোটি ভোটারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে, ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয় তাহলে কী হতে পারে? আমি এ বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত।

ইভিএমের বিষয়টি সামনে এসেছে, কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য সংসদীয় নির্বাচনে সর্বত্র ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এটা ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা। তবে মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ঘটনাপ্রবাহ সাধারণ জনগণকে চরম হতাশ করেছে। ফলে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি এখন মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা এখনও এ বিষয়টি নিয়ে মনস্থির করতে পারেনি। তারা সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নেবেন।  বিএনপি এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পুরোপুরি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা এ মেশিনকে 'স্বয়ংক্রিয় জাল ভোট দেওয়ার মেশিন' বলে অভিহিত করেছেন। তাদের দাবি, এ মেশিনগুলোকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যায়, ভোটার যে মার্কার ওপরেই চাপ দেন না কেনো, একটি পূর্বনির্ধারিত মার্কার পক্ষে ভোট পড়বে। ভোটগ্রহণের কাগজেকলমে কোনো প্রমাণ থাকবে না। যদিও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে কি না, তা সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে চাপের মুখে ফেলেছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নামিবিয়া, নেপাল, আর্মেনিয়া, ভুটান, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, পেরু, ভেনিজুয়েলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো কোনো না কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে নেদারল্যান্ডে ইভিএমের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৯ সালে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডে ইভিএম ব্যবহারের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। ইতালিতেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই বছরের মার্চে জার্মানির সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়া অসাংবিধানিক। রায়ে আরও বলা হয়, নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা হচ্ছে একটি সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, কিন্তু উপযোগিতা বিষয়ে সেরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ২০০৩ সালে নরওয়েতে ইভিএমের ব্যবহার বন্ধ হয়। পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে একবার করে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সে দেশগুলোও এ প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৪টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেন, যেখানে অনেকেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনও বেশ কিছু অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করেছে এবং তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। অনেকে ইভিএমের সঙ্গে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) ব্যবহারের সুপারিশ করেন, যাতে ভোটাররা তাদের ভোট দেওয়ার পর একটি কাগজে মুদ্রিত রশিদ সংগ্রহ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গত সপ্তাহে আলাপ করেছে। বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, ইভিএম প্রযুক্তিতে কারসাজি করা প্রায় অসম্ভব।

ইভিএমের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো মূলত প্রযুক্তির নয়, ভরসার। যখন ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে  অবিশ্বাস বেশি থাকে, তখন ইভিএম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে তেমন কোনো লাভ নেই। বরং এতে দুই পক্ষের মধ্যে চিন্তাধারার ব্যবধান আরও বাড়বে এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করাতে সরকারের স্বদিচ্ছার অপমৃত্যু ঘটাবে। বাংলাদেশের মতো দেশে ভোটগ্রহণ একটি উৎসবের মতো বিষয়, যেখানে মানুষ আনন্দের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত গত ২টি সাধারণ নির্বাচনে অনেক মানুষকে তাদের ভোট দিতে পারেননি। যদি নির্বাচন কমিশন একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যেখানে সব ভোটার ঝামেলা ছাড়া ভোট দিতে পারবে, সে ক্ষেত্রে ইভিএমের মতো বিতর্কিত বিষয় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারার কথা না। মেশিনের কাজ হচ্ছে একটি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা, কিন্তু এতে যদি ঝামেলার অবতারণা হয়, তাহলে মানুষ ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হবে এবং সার্বিক ভাবে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এছাড়াও, আমি আগে যেমন বলেছি, এটি একটি ভরসার বিষয়, প্রযুক্তির না। যদি যথেষ্ট পরিমাণ ভরসা না থাকে, তাহলে কেন আমরা ব্যালটের পরিবর্তে ইভিএম ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছি?

মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা: দ্য ডেইলি স্টারের ডেপুটি চিফ রিপোর্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

8h ago