কূটনীতিকের ‘বড়দিনের কার্ড বিনিময়’ ও মন্ত্রীদের অমৃতবচন!

কে না জানেন, কূটনীতির নিজস্ব এক ভাষা আছে, যাকে বলা হয় কূটনৈতিক ভাষা। অভিধানের ভাষার সঙ্গে এই ভাষা সবসময় নাও মিলতে পারে। এই ভাষা এতোই স্পর্শকাতর যে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ছোট বিষয়েও লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেতে পারে। সে কারণেই যারা কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন তাদের ভাষা এবং ভাষা ব্যবহারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এত কিছুর পরও কখনো কখনো এমন কিছু ঘটনার সাক্ষাৎ মেলে যেখানে বিশেষ কোনো দেশের কূটনীতিক অন্য দেশের কূটনীতিক কিংবা সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে এমন শব্দ ব্যবহার করে বসেন, তাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ফাটল ধরার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই ধরনের ঘটনা দুটো কারণে ঘটতে পারে। এক: অসাবধানতা, দুই: ইচ্ছাকৃত। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে যিনি তা ব্যবহার করেন তার সচেতন প্রয়াসই থাকে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো দ্বিতীয় পক্ষ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা আদায় করা।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর এক বক্তব্য শুনে আমার এই কথাগুলো মনে পড়ল। প্রসঙ্গ ছিল পি কে হালদার। যে কথা সবাই জানেন, গত ১৪ মে বাংলাদেশের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা মামলার প্রধান আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে ভারতের অর্থ সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) গ্রেপ্তার করেছে। সাংবাদিকরা তারই প্রত্যর্পণ বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর কাছে। জবাবে তিনি বললেন, 'এটি আইনি বিষয়। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে জানানো হবে। বুঝতে হবে, এটি কিন্তু বড়দিনের কার্ড বিনিময় নয়।' নিরেট সত্য কথা। এ যে আইনি বিষয়, তা কে-ই বা না জানে? কিন্তু এই যে 'বড় দিনের কার্ড বিনিময়' এটা যেন একটু কেমন শোনায়, বিশেষ করে কূটনৈতিক আলোচনায়। যতটুকু জানি দোরাইস্বামী একজন মেধাবী ও দক্ষ কূটনীতিক। ভারত সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বাংলাদেশে আসার আগে দীর্ঘদিন যুগ্মসচিব হিসেবে দিল্লির সাউথ ব্লকে বসে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার কাছ থেকে এমন ভাষায় জবাব আমার কাছে ঠিক কূটনীতিকসুলভ মনে হয়নি। বলাবাহুল্য, গত মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন ভারতীয় হাইকমিশনার।

এদিকে, একই দিনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার নিজ মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ভালো খাবারের আশায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে আসছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গত ১২ বছর ধরেই অনেক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছেন। কিন্তু ভারতের খাবার তাদের মনঃপূত নয়। তাই তারা ভালো খাবারের আশায় বাংলাদেশে আসছেন। কী অভিনব যুক্তি! একটি দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের- তাও পররাষ্ট্রমন্ত্রী- একজন ব্যক্তি কেমন করে লাখ লাখ অসহায় মানুষের দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে চলাকে ভালো খাবারের প্রতি আকর্ষণের সঙ্গে মেলাতে পারেন- মাথায় ঢুকে না। তিনি কি ভুলে গেছেন ১৯৭১ সালে আমাদের দেশেরই এক কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেটাও কি তবে ভালো খাবারের আশায়? পাকিস্তানে থেকে আমরা ভালো খাবার খেতে পেতাম না,  তাই একটু ভালো খাবারের আশায় আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, কী অদ্ভুত তত্ত্ব! আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন ভাষা চয়নকে কেউ যদি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৈন্যতার পরিচায়ক বলে গণ্য করেন তাহলে কি খুব ভুল হবে? বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

অবশ্য শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেই দোষ দিয়ে লাভ কী? আমাদের মন্ত্রীদের অনেকেরই অহরহ এমন হাস্যকর কথা বলার খ্যাতি আছে। সে কারণে মানুষ তাদের কথাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। বিএনপি আমলে এক মন্ত্রীর 'লুকিং ফর শত্রুজ' আর আরেক মন্ত্রীর 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে' জাতীয় মন্তব্যগুলো সে সময়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। আওয়ামী লীগ আমলেও এমন ব্যক্তির অভাব নেই। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যখন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেল, সে সময়ের এক মন্ত্রী দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলেছিলেন 'বিরোধী দলের ধাক্কায়' ভবনটি ধ্বসে পড়েছিল। করোনাকালে আমাদের মন্ত্রীদের বচনামৃত বর্ষণ আরও বেড়ে গিয়েছিল। তখন প্রায়শই শোনা যেত 'আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী'! যেন বাঙালী জাতি এক ভাইরাস জাতি, তাই করোনা ভাইরাসের সঙ্গে তার তুলনা! সাম্প্রতিক সময়ে তেলের ঊর্ধ্বগতির জন্য আমাদের একেক মন্ত্রী  একেক তত্ত্ব হাজির করে চলেছেন। কেউ বলছেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বাড়ছে, কেউ বলছেন বিরোধীদলের কারসাজিতে বাড়ছে। কেউই বিষয়টির অর্থনীতিক ও তাত্ত্বিক দিকে নজর দিচ্ছেন না। এসব কিছুই যে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও প্রজ্ঞার দৈন্যতারই পরিচায়ক, তা বলাই বাহুল্য।

এই মন্ত্রী বচনে আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। গত ১৭ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা শেষে তিনি বলেছেন, তার নাকি ডানা কেটে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখন থেকে তিনি 'ডানাকাটা মন্ত্রী'। আসলে ওই সভায় ইতোপূর্বে তিনি যে আনলিমিটেড পরিমাণের প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারতেন, তা কমিয়ে তার ক্ষমতা ৫০ কোটি করা হয়েছে। এতেই তিনি কিছুটা হতাশার সুরেই বলেছেন, তার ডানা কাটা হয়ে গেছে। রক্ষা যে তিনি বিপরীত লিঙ্গের কেউ নন। যদি হতেন, তার ডানা কাটা নিয়ে এতক্ষণে আরও মুখরোচক প্রবাদ চালু হয়ে যেত।

যাকগে, যেহেতু কূটনীতিকদের মতো রাজনৈতিক মন্ত্রীদের ভাষা প্রশিক্ষণের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, তাই তাদের নিজেদেরই নিজেদের বচনামৃত নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে জনগণ যদি তাদের ভাষার অপব্যাখ্যা করে বসেন, তাহলে জনতার দোষ ধরা চলবে না।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

India bans import of certain jute products, woven fabrics from Bangladesh via land ports

Today's action by DGFT came a little more than one month after India had imposed port restrictions on the import of certain goods like readymade garments and processed food items from Bangladesh via land routes

7m ago