কেন খেলার মাঠ জরুরি?

স্বাধীন দেশে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ একবার তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এই যে খেলার মাঠ সব দখল হয়ে যাচ্ছে, ছেলেরা সব কই যাবে? রাস্তা ঘাটে ঘুরবে, অকারণে বাজারে যাবে, মানুষের পকেটে হাত ঢুকাবে।’
তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার দাবিতে স্থানীয়রা যখন ব্যানার হাতে দাঁড়িয়েছেন, তখনও সেখানে আপন মনে খেলতে শুরু করে ২ শিশু। ২৫ এপ্রিল ২০২২। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

স্বাধীন দেশে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ একবার তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'এই যে খেলার মাঠ সব দখল হয়ে যাচ্ছে, ছেলেরা সব কই যাবে? রাস্তা ঘাটে ঘুরবে, অকারণে বাজারে যাবে, মানুষের পকেটে হাত ঢুকাবে।'

মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সে রাষ্ট্রনায়কের ভবিষ্যদ্ববাণীই ফলছে। পরিবর্তিত সময়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও সংকট আরও গভীর। শুধু মানুষের পকেটে হাত দিচ্ছে না, ভদ্র ঘরের ছেলেরা আজকাল মাদক সেবনের জন্য বাবার বা ভাড়াটে প্রাইভেট কার নিয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে অবলীলায় মানুষও খুন করছে। পথে-ঘাটে উত্যক্ত করছে নারীকে, জড়িয়ে পড়ছে আরও নানা অপরাধে।

তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। সবুজ-সুন্দর শৈশব নেই। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো উন্মুক্ত জায়গা নেই। সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই। অথচ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ জরুরি। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জায়গা জরুরি। ঘরে বসে বসে মোবাইলে গেম, কম্পিউটারে বিদেশি সিনেমা-সিরিয়ালে আসক্তি, কখনো বিকৃত যৌনাচার, পর্নোগ্রাফি দেখে ক্লান্ত ও হতাশাগ্রস্ত তারা।

গত ২ দশকে ভূমিখেকোদের কালো থাবায় শহর দূরে থাক, গ্রাম-গঞ্জেও আমাদের শৈশবের বিশাল বিশাল মাঠগুলো রাতারাতি যেন হারিয়ে গেল। ঘরবন্দি আকাশ সংস্কৃতিতে নয়, আমরা তো মাঠে, উন্মুক্ত প্রান্তরে খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। পাঠাগারে রোজ বিকেলে পড়তে পড়তে বেড়ে উঠেছি। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে খেলার মাঠ দরকার, পাঠাগার ও ঘরে ঘরে পাঠাভ্যাস-সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। অথচ আমাদের পাঠাগারগুলোর অস্তিত্ব আজ ধ্বংসের কিনারায়।

পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষা, প্রকৃতি ও আকাশের বিশালতা দেখতে দেখতে বড় না হলে মানুষ কখনো উদার হতে পারে না। জলে ও জোছনায় মন আর্দ্র না হলে মানুষ বড় হয় কেমন করে? শুধু বিরাট বিরাট কংক্রিটের ভবনে আর বিদেশি মাধ্যমে পড়াশোনা করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন মানুষকে মানুষ করে তোলে না।

সুবিধার সুনীল জলধিতে বিবেক বন্ধক দিয়েছেন আমাদের আমলা, চতুর বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা। তা না হলে বিশ্বস্ত দালাল আর চাটুকার না সেজে সমস্বরে সবাই রাষ্ট্রকে বলতেন, হাজারো কোটি টাকা খরচ করে সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, কামান আর নতুন নতুন সুদৃশ্য ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলার চেয়ে পাড়ায় পাড়ায় মাঠ গড়ে তোলা আজ ঢের জরুরি। জরুরি প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী ভূমিখেকোদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা জরুরি।

বেগম পাড়ায় আমাদের বাড়ি নেই। আমাদের সন্তানদের জন্য পাড়ায় এক খণ্ড সবুজ উদ্যান চাই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য উপাসনালয় নয়, সুলভে গরীবের চিকিৎসা হয় এমন নতুন সুবিশাল হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি। জরুরি মুক্ত বাতাসের জন্য নগরজুড়ে উদ্যান, পাখিদের কলরব গান, শিশুদের অবারিত, উন্মুক্ত খেলার মাঠ।

গতকাল রোববার ঢাকার তেঁতুলতলা খেলার মাঠ রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় সমাজকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে মোহাম্মদ ঈসা আব্দুল্লাহকে কলাবাগান থানায় তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। নাগরিক প্রতিবাদের মুখে পরে অবশ্য ছেড়েও দিয়েছে।

একজন মা জানেন তার সন্তানের বিকাশের জন্য একটি খেলার মাঠ কত জরুরি। এই মা বাংলাদেশের সমগ্র মায়ের হয়ে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও বিকাশের পক্ষে কথা বলছেন। দেশের মানুষ এই মায়ের পক্ষে। তিনি তার সন্তানের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আজ সকল মায়ের। তাদের চোখের সামনে অনেক সন্তান মাদকাসক্ত হচ্ছে, বখাটে হচ্ছে। এভাবে কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই মায়ের আর্তি আমাদের বিবেক ও বোধকে স্পর্শ করে। আমরা খেলার মাঠ, বৃক্ষশোভিত নগর ও শিশুবান্ধব শহর চাই। ঢাকা জেলা প্রশাসন তেঁতুলতলা খেলার মাঠ এলাকাবাসীর কাছে ফিরিয়ে দিক।

সুকান্তের কথা মনে পড়ে,

'প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি—

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram shoe factory fire under control

A fire that broke out at a shoe accessories manufacturing factory on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon was brought under control after two hours.

2h ago