ক্ষমতাসীন দলের নেতা কি আইনের ঊর্ধ্বে!

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় গত কয়েক বছরে অসংখ্য মামলা হয়েছে। বিনা বিচারে শত শত নাগরিক জেল খেটেছেন। ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা ও প্রচারণায় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে বিতর্কিত আইনের এ ধারাটিতে।
jahangir.jpg
জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় গত কয়েক বছরে অসংখ্য মামলা হয়েছে। বিনা বিচারে শত শত নাগরিক জেল খেটেছেন। ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা ও প্রচারণায় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে বিতর্কিত আইনের এ ধারাটিতে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সদ্য সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জাহাঙ্গীর আলমের ভাইরাল হওয়া অডিওটি বিশ্লেষণ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি স্পষ্ট। অন্য কোনো দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলে তাদের স্থায়ী আবাস হতো কারাগারে, এমন নজির নিকট অতীতে আছে।

একই সিটি করপোরেশনের বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়র এম এ মান্নান বা সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক কারাবাস করেছেন, হারিয়েছেন মেয়র পদ। যদিও জাহাঙ্গীর আলমের মতো জাতির পিতাকে কটাক্ষ করার অভিযোগ ছিল না। তারা মেয়র পদ হারিয়েছেন অন্য ফৌজাদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার পরই। আদালতে বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অপেক্ষা করেনি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণের সাথে সাথে সিটি করপোশনের মেয়র ও কাউন্সিলরকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) সংশোধিত আইনে।

তবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বেপরোয়া জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে কটূক্তির মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ ওঠার পরও কোনো আওয়ামী লীগ কর্মী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য দেশের কোথাও মামলা করেননি। কারণ জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর এই ঘটনা প্রমাণ করল, ক্ষমতাসীন দলের পদে থাকা ব্যক্তি কোনো ফৌজদারি অপরাধ করলেও দলীয় পদ থাকা পর্যন্ত তিনি আইনের ঊর্ধ্বে।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তে জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত মেয়রকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কারের পর জাহাঙ্গীর আলমের মেয়র পদে থাকা না থাকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে মেয়র পদ থেকে।

দল থেকে বহিষ্কৃত হলে দলীয় প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্যের পদ চলে যাওয়ার বিধান থাকলেও স্থানীয় সরকার আইনে এমন বিধান রাখা হয়নি। তবে অন্য কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করলেই তার মেয়র পদ চলে যাবে, এটি নিশ্চিত।

সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির প্রধানতম কারণ ছিল বিদ্রোহী জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা। আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের চাপ সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর আলম নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। নামকাওয়াস্তে নিজের প্রার্থিতা যখন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জনমনে ধারণা হয়, বিএনপি প্রার্থী এম এ মান্নানের জয় নিশ্চিত জেনেই ঘোষণাটি দেন তিনি। যদিও প্রত্যাহার ঘোষণার পরও ঝুট ব্যবসায়ী (গার্মেন্টস ওয়েস্টেজ) এবং এক সময়ের স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের নাম ব্যালট পেপারে ছিল। স্থানীয় জনগণ এটিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহর মতো প্রবীন রাজনীতিকের হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ মনে করলেও সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগই ছিল দলীয় প্রার্থীর শত্রু।

সাংস্কৃতিক কর্মী, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য, ৯০ দশকে সরকারি কর্মকর্তার বস্ত্রহরণকাণ্ডে সমালোচিত এক সাবেক ছাত্রনেতা বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট হয়ে জাহাঙ্গীরকে নির্বাচনে দাঁড় করাতে ভূমিকা রেখেছিলেন, যাতে বিএনপি প্রার্থী মান্নানের জয় নিশ্চিত করা যায়। ২০০১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর হাওয়া ভবন নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়া এবং পরবর্তীতে ভিকটিম কার্ড ব্যবহার করে ফিরে এসে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক উপকমিটির এই সদস্যের ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মূল অ্যাসাইনমেন্টই ছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহর পরাজয় নিশ্চিত করা। সাথে যোগ হয় জাহাঙ্গীরের কালো টাকার কাছে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার সমর্থন। কয়েক দফা টঙ্গী পৌরসভার মেয়র থাকাকালীন আজমত উল্লাহর নিজ এলাকার উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দিলেও অন্য এলাকাকে অবহেলা করেছিলেন, যা ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগের ভরাডুবির আরেকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আজমত উল্লাহর মতো পোড় খাওয়া এবং জনপ্রিয় নেতার ২০১৩ সালের একমাত্র হারের পরের বার অর্থাৎ ২০১৮ সালে গাজীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তুলনামূলক অপরিচিত ও জুনিয়র নেতা এবং ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মতো বড় এবং ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন দেওয়ার কী কারণ ছিল? আলোচনা আছে, জাহাঙ্গীর আলমের টাকার কাছে হেরে গিয়েছিলেন একজন শীর্ষ নেতা। স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আজমত উল্লাহ সম্পর্কে ভুল বুঝিয়ে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন।

ঠিক এমন একটি অভিযোগ আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের পর গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানকে তার সম্পর্কে ভুল বোঝানো হয়েছে।

দলীয় কোন্দলের সুযোগে টাকার কুমিরখ্যাত জাহাঙ্গীরের উত্থান হয় মূলত ২০১৮ সালে। মেয়র হওয়ার পর তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন জেলার সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নামে তিনি মূলত তার বিরোধীপক্ষ সিনিয়র নেতাদের অনুসারীদের কোণঠাসা করতে শুরু করেন। নিজেকে ভাবতে থাকেন অপ্রতিরোধ্য। এমনকি কুণ্ঠাবোধ করেননি নারীর সাথে বিবাদে জড়িয়ে অকথ্য ভাষার ব্যবহার করতে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে তখন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আপত্তিকর বক্তব্যে স্থানীয় নেতা কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দলীয় পদ হারিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরের কিছু গুণের কথাও শোনা যায়। উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিশ্রম, অকাতরে দান-অনুদান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে নাগরিক সমাজের একটি অংশের কাছে তিনি প্রশংসিত ছিলেন যা তাকে নিজ দলের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আরও বেপরোয়া করে তোলে।

হঠাৎ করে ফিল্মি কায়দায় অভাবনীয় উত্থানে জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে ভারতীয় পরিচালক এস শংকরের 'নায়ক‌' সিনেমার শিবাজি রাও চরিত্রে নিজেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন কি? ওই সিনেমায় টিভি ক্যামেরাম্যান শিবাজি রাও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যান একদিনে। তার অফিসে আসা বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বলরাজ চৌহান আলোচনার একপর্যায়ে বলেন, রাজনীতিতে আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা। শিবাজি রাও জবাব দেন, তোমার সাথে এক বছর লড়তে লড়তে আমার অভিজ্ঞতা একত্রিশ বছরের হয়ে গেছে। এস শংকর তার গল্পের নায়ক শিবাজি রাওকে সিনেমায় যেভাবে দেখাতে চেয়েছেন তিনি সেভাবে দেখিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো নয়। সিনেমায় শিবাজি রাওয়ের পতন হতে দেন না চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। বাস্তবে জাহাঙ্গীর আলমদের যেমন দ্রুত উত্থান হয়, পতন হয় তার চেয়ে তীব্র অর্থাৎ ঝড়ের গতিতে।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
  July massacre victims

Dubious cases are an injustice to July massacre victims

Legal experts opined that there should be a judicial investigation into these cases.

9h ago