গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী: দুটি বিকল্প প্রস্তাব
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষিতে চলাফেরায় কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে গণপরিবহনে আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সেই নির্দেশনা মেনে চলছেন কি না, সরকার তাদেরকে এই নির্দেশনা মানতে বাধ্য করতে পারছে কি না, কমসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের বাধ্যবাধকতা থাকলে ভাড়া বাড়বে কি না—এসব নিয়ে কয়েকদিন ধরেই তুমুল আলোচনা চলছে।
তবে যে বিষয়ে আমরা খুব কম কথা বলছি সেটা হচ্ছে, পরিবহণে যাত্রী সংখ্যা অর্ধেক হলে শহর কী পুরোপুরি চালু থাকতে পারবে? বাকি অর্ধেক মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন যদি না কমে, শুধুমাত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা যদি সীমিত হয়ে পড়ে, তাহলে তারা করবেন কী!
মূল সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত গণপরিবহণ নেই। গণপরিবহণ যখন পূর্ণ আসন সংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাফেরা করে, তখনো বাসস্ট্যান্ডে মানুষের ভিড় থাকে। সকালে কাজে যাওয়ার সময় বা বিকেলে কাজ থেকে ফেরার সময় গণপরিবহণে ওঠা প্রায় দুঃসাধ্য। তবুও মানুষকে উঠতে হয়। চিড়েচ্যাপটা হয়ে গন্তব্যের দিকে রওনা হতে হয়।
অফিসের নিয়মের কারণে ইস্ত্রি করা শার্ট আর টাই পরতে হয় যে ছেলেটির, ভিড়ঠাসা বাস থেকে ঠেলাঠেলি করে নেমে জামার কুঁচকানো ঠিক করতে করতে সে মনে মনে কী বলে! অথবা সেই মেয়েটি? যে বাসে সিট না পেয়ে একগাদা মানুষের চাপাচাপির মধ্যে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে গন্তব্য কখন আসবে সেই অপেক্ষায় থাকে? হয়তো পাশের একাধিক সহযাত্রী তার শরীরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে, সে আড়ষ্ট হয়ে থাকে যাত্রার পুরোটা সময়। এই মানুষগুলোর কে চায় পয়সা দিয়ে দাঁড়িয়ে বাসভ্রমণ করতে?
অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে, একটা-দুটো বাসে উঠতে পারেননি ভিড়ের কারণে, পরের বাসটা আসার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েছি কখনো? বাসে যাত্রী কমিয়ে দিলে তার কী হবে, সেটা কি ভাবছি আমরা? নাকি ভাবছি, ১০ টাকার বদলে ১০০ টাকা দিয়ে ভ্যানে যাক তারা, অথবা হাঁটুক। যারটা সে বুঝুক।
বিকল্প কোনো ব্যবস্থা তো তার জন্য নেই। শ্যামলী থেকে গুলশান যেতে ভিড়ের সময় সিএনজিতে লাগে ৩০০ টাকার মতো, ট্যাক্সিতে আরও বেশি, মোটরসাইকেলে ১৫০ টাকার মতো। সেখানে বাসে যাওয়া যায় ২০ টাকাতেই। শহরের কত শতাংশ মানুষ ২০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা খরচ করার সামর্থ্য রাখেন, সেটা ভাবতে হবে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও হয়, সকলের পকেট ভর্তি টাকা আছে, তখনো কি তারা প্রয়োজনের সময় সিএনজি বা ট্যাক্সি পাবেন? বাসে যত যাত্রী নিয়মিত যাতায়াত করেন, তার ২০ শতাংশ বহন করার মতো সিএনজি বা ট্যাক্সি কি আছে ঢাকা শহরে?
এই শহরে সবকিছু একইরকম চালু থাকবে; মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন কমবে না। কিন্তু গণপরিবহণে স্বাভাবিকের এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী যাতায়াত করবেন। এটা কিভাবে সম্ভব? আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রীকে ৩ ভাগের ১ ভাগ যাত্রী বলছি। কারণ, আসন সংখ্যার বাকি অর্ধেক খালি থাকবে এবং দাঁড়িয়ে যাত্রী যেতে পারবেন না। তাহলে গণপরিবহণের নিয়মিত যাত্রীদের ৩ ভাগের ২ ভাগ মানুষ কাজে যাবেন কীভাবে? কাজ থেকে ফিরবেন কীভাবে? তারা কি মাইলের পর মাইল হাঁটবেন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন? ১০ টাকার বাস ভাড়ার জায়গায় পিকআপের পিছনে বা রিক্সাভ্যানে ১০০ টাকা দিয়ে গাদাগাদি করে যাতায়াত করবেন? আমরা আসলে তাদের জন্য কী ভাবছি!
যে এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী গণপরিবহণে চলাফেরা করবেন, তাদের জন্য ভাড়া বাড়াতে দেওয়া যাবে না। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিছুদিন আগেই। তেলের যতটা দাম বেড়েছে, ভাড়া বেড়েছে তার ৪ গুন। এখন বিশেষ পরিস্থিতিতে আরও ভাড়া বাড়িয়ে সাধারণ যাত্রীদের ওপর চাপ বাড়ানোর সুযোগ নেই। এদিকে মোটরসাইকেল, সিএনজি ও ট্যাক্সির ভাড়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাদানকারী ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানি একই দূরত্বে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চার্জ করছে। এমনসব অযৌক্তিক অংকের বিল চলে আসে যে যাত্রী অবাক হয়ে যান। আজ যে দূরত্বে ২৫০ টাকা ভাড়া, পরেরদিন সেই দূরত্বে ৩০০ টাকা বিল চলে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে দূরত্ব একই থাকলেও ৩৫ শতাংশ ভাড়া কি জ্যামের কারণে বেড়ে যেতে পারে? তারা এখানে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ভাড়া ঠিক করছেন। কিন্তু বেশি চাহিদার সময় ইউনিট প্রতি মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ যদি দেওয়াও হয়, সেটা নির্ধারিত রেটের কত শতাংশ। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাদানকারী কোনো কোম্পানিই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার হার মানছে না।
কোনো কোনো সেবার ক্ষেত্রে তো নির্ধারিত রেট বলে কিছু নেই। এইসব বিলের অংক নিয়ন্ত্রণে, সার্ভিসগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা রয়েছে।
আর রাস্তায় দরদাম করে যানবাহন ভাড়ার ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। তেলের দাম বৃদ্ধির পর সিএনজি ভাড়াও বেড়ে গেছে এই শহরে। সিএনজি তো তেলে চলে না, এর ভাড়া বৃদ্ধি কেন—এমন প্রশ্নের সবচেয়ে মৃদু জবাব হচ্ছে, 'গেলে চলেন, না গেলে বাদ দেন'। যানবাহন সংকটের এই শহরে যাত্রীর খুব কিছু বলার থাকে না। বাসে যাত্রী কমে গেলে এদের সবার আবার লাভের ওপরে লাভ।
এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য মোটেই কোভিড নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখা না। কিন্তু আমরা তো কোভিডের মধ্যে ২ বছর পার করলাম। এখনকার নীতি নির্ধারণে সেই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকতে হবে তো। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এখন লকডাউন দেওয়া ও সেটা মানুষকে মানানো সহজ হবে না। সুতরাং, পথে একই সময়ে, বিশেষত সকাল ও বিকেলে, যাত্রীর চাপ কমানোর চেষ্টা করাই সম্ভবত গণপরিবহণে কোভিড বিষয়ক নিরাপত্তা নির্দেশনা মানতে সহায়তা করতে পারে। করোনা সংক্রমণের হার কমার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে ২টি প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করতে পারে।
প্রথম প্রস্তাব
আপদকালীন এই সময়ের জন্য সপ্তাহে কাজের দিন কমিয়ে আনা যেতে পারে। শনিবার ছুটি আপাতত বাতিল করে অফিসগুলোকে অল্টারনেটিভ দিনে সশরীরে অফিস করার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। অর্ধেক সংখ্যক অফিস, বাজার দোকান শনি, সোম ও বুধবারে খোলা থাকবে এবং বাকি অর্ধেক খোলা থাকবে রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবারে। এতে রাস্তায় প্রতিদিনের যাত্রীর চাপ অর্ধেকে নেমে আসবে। বাকি দিনগুলোতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইনে অফিসের কাজ চলতে পারে।
কোনো কোনো এলাকায় পকেট মতো করে পুরোপুরি লকডাউন দেওয়ার গত বছরের যে ট্রায়াল, সেটা কাজে আসেনি। এবার যানবাহন চালু রেখে যাত্রীর বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজনকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বড় বড় জোন না করে ছোট ছোট জোনে শহরটাকে ভাগ করে জোনগুলোকে ২টি গুচ্ছে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে কোনো রুটে যাত্রীর চাপ খুব বেশি আর কোনো রুটে যাত্রীর চাপ খুব কম হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
দ্বিতীয় প্রস্তাব
সব কিছু সপ্তাহে ৫ দিনই খোলা থাকবে, কিন্তু কাজের সময়ের পার্থক্য হবে। অর্ধেক অফিস, বাজার খোলা থাকবে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। বাকি অর্ধেক খোলা থাকবে সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। তাহলে গণপরিবহনে যাত্রীর চাপ অর্ধেক হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রেও শহরকে ছোট ছোট জোনে ভাগ করে জোনগুলোকে ২টি গুচ্ছে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে।
করোনাকালীন একটি বিপদের মুহূর্তে কাজের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম করে হলেও গণপরিবহনে ভিড় কমানোর জন্য এবং পরিস্থিতি নগরবাসীর জন্য সহনীয় রাখার জন্যে এ রকম আরও অনেক বিকল্প নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা তারপর সবগুলো বিকল্প থেকে সেরা বিকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেন। এর সঙ্গে কোভিড নিরাপত্তার জন্য অন্যান্য সাবধানতা তো থাকবেই।
তাপস বড়ুয়া: ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments