ঘরে ফেরার এত তাড়া কেন?

ঈদ আসলেই বাস, ট্রেন, লঞ্চে মানুষের উপচে পড়া ভিড়, পথে পথে ভোগান্তি। দুঃখজনকভাবে সড়কে ঝরে যায় বেশ কতগুলো প্রাণ। তবু মানুষ ছুটছে। প্রতিবছর ছুটির সময়ে একই দৃশ্য। পথের এই কষ্ট, এই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মানুষ কেন ঢাকা ছাড়ে! কেন ছুটে যায় তার ‘দেশের বাড়ি’!

ঈদ আসলেই বাস, ট্রেন, লঞ্চে মানুষের উপচে পড়া ভিড়, পথে পথে ভোগান্তি। দুঃখজনকভাবে সড়কে ঝরে যায় বেশ কতগুলো প্রাণ। তবু মানুষ ছুটছে। প্রতিবছর ছুটির সময়ে একই দৃশ্য। পথের এই কষ্ট, এই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মানুষ কেন ঢাকা ছাড়ে! কেন ছুটে যায় তার 'দেশের বাড়ি'!

'আপনার দেশের বাড়ি কোথায়' পরিচয়ের শুরুতে এটা একটা কমন প্রশ্ন আমাদের দেশে। 'ঢাকায় কোথায় থাকেন'—এই প্রশ্ন আসে সাধারণত আরও পরে। 'দেশের বাড়ি' ব্যাপারটা আবেগের, নস্টালজিয়ার, আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। মানুষের ফেসবুকের টাইমলাইন দেখলে বোঝা যায় নিজের শেকড় 'দেশের বাড়ি' নিয়ে আমাদের আবেগ কতোটা প্রবল।

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এই দেশের বাড়ির প্রতি আবেগকে, টানকে খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় উৎসবের দিনগুলোতে। পথের প্রচণ্ড ঝক্কি নিয়েও মানুষ বড় শহরগুলো খালি করে কয়েকদিনের জন্য ফিরে যায় গ্রামে বা মফঃস্বল শহরে।

ঢাকার জীবন ব্যস্ত জীবন। মুহূর্তের অবসরে মনে হয়, 'কোন আধমরা জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি'। ঢাকার মানুষ অধিকাংশই অমলিন স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ভুলে যায়। সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মানুষের মুখের দিকে তাকালে ক্লান্তির ছাপ পরিষ্কার দেখা যায়, অনিশ্চয়তার উত্তাপ অনুভব করা যায়। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মানুষের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা ধরা পড়ে। এটা শুধু বাস আসার অপেক্ষা নয়। জীবনের সার্বিক অনিশ্চয়তার উৎকণ্ঠা। বাসের মধ্যে অফিসের ফোন, কণ্ঠস্বর নরম করে ক্লায়েন্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, জ্বী জ্বী করে বসের ঝাড়ি হজম করা—সব শোনা যায় অফিসগামী বা অফিসফেরত মানুষের কথায়।

বাস কন্ডাক্টর বা হেল্পারের সঙ্গে বচসা, সহযাত্রীর সঙ্গে উত্তেজিত কথা কাটাকাটি—এসব আসলে জীবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অফিসের বসের অনাবশ্যক গালি গিলে যাওয়া, আর্থিক অনিশ্চয়তা, চাকরি চলে গেলে কোথাও পাবো কি না তার দুশ্চিন্তা, ব্যাংক ঋণের কিস্তি, ক্রেডিটকার্ডের লিমিট ৯৫ শতাংশ অতিক্রম, সন্তানের স্কুলের বেতন নিয়ে চিন্তা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসবের মোক্ষম প্রভাব পড়ে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর উপর। সবমিলিয়ে নগর জীবন প্রতিমূহূর্তে বিষ হজম করার জীবন। সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ 'মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ' বইতে কলকাতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, মেট্রোপলিশ দিনে দিনে নেক্রোপলিশ (মৃতদের নগরী) হয়ে উঠছে। আসলেই হয়তো মেট্রোপলিশের অধিবাসীরা এক একটা জীবন্ত লাশ।

কয়েকবছর আগে কাকরাইল মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় এক সাংবাদিক মারা যান। পরে পত্রিকায় খবর হয়েছিল, তিনি ওইদিন মাটির ঘট ভেঙে শেষ সঞ্চয় কয়েকটা টাকা পকেটে করে বের হয়েছিলেন। আর সঙ্গে ছিল একরাশ অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। খবরটা যতদূর মনে পড়ে, বাস চাপা দেয় তার মোটরসাইকেলটিকে। যিনি সংসারের আয়ের উৎস, তার জীবন উৎকণ্ঠায় ভরা প্রতিমুহূর্তে।

মানুষ পালাতে চায় ব্যস্ত শহর থেকে বহুদূরে। অনেক বছর আগে যখন বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকার প্রথম এ্যামিউজমেন্ট পার্ক ফ্যান্টাসি কিংডম যাত্রা শুরু করে, তখন তারা পোস্টারে লিখেছিল, 'স্কেইপ টু ফ্যান্টাসি কিংডম'। পালান এই ব্যস্ত জীবন থেকে, কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান সব। ঢাকায় আসলেই খোলা জায়গা নেই। একটা বিকেল পরিবার নিয়ে আকাশ দেখার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক মাঠ বা পার্ক নেই।

পালাবে কোথায় মানুষ? কোথায় তার সেই একান্ত ভুবন? ওই শৈশবের স্মৃতির কাছেই সে যায়, পালায়। চিত্রশিল্পী সমর মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি এখনও মনে মনে শৈশবের নদীর পাড় ধরে হাঁটি। মিহির সেনগুপ্ত তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সবার মনের মধ্যেই থাকে একটা সিদ্ধিরগঞ্জের মোকাম। এই সিদ্ধিরগঞ্জের মোকাম, এই নদীর পাড়ই হতে পারে একান্ত আশ্রয়। হয়তো গিয়ে দেখা যায়, বদলে গেছে সব। তবু ছিল, এখানেই ছিল, আমি সেখানেই এলাম—এই তো সান্ত্বনা।

হয়তো ভাই-বোন ৩ জন ৩ জায়গায় থাকেন, সারা বছরে সবার ছুটি মিলিয়ে দেখা হওয়ার এই একটি বা ২টি সুযোগ। পারিবারিক অনুষ্ঠান, জমিজমা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা, সবকিছুর সুযোগ করে দেয় এই ছুটিগুলো। ঢাকাবাসীর একটা বড় অংশের পরিবার থাকে গ্রামে। কারণ, স্বল্প আয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্ত্রী-স্বামী সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ তার বছরে ওই একবার বা ২ বার। সুতরাং সে পড়িমরি করে ছোটে।

গতবছর মাওয়া ফেরিঘাটে প্রচণ্ড ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে একজনের ব্যাগ নদীতে পড়ে যায়। তিনি পদ্মায় ঝাঁপিয়ে পড়েন ওই ব্যাগ তুলে আনতে। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ওই ব্যাগে তার মেয়ের জন্য কেনা নতুন জামা ছিল। সেটা ভেসে যেতে দিতে পারেন না তিনি। এই হচ্ছে আমাদের সম্পর্কগুলো। এর জন্য পথের কষ্ট সহ্য করা তো তুচ্ছ ব্যাপার।

তাইতো ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত মানুষদের সঙ্গে দেখা, সুখ-দুঃখের আলাপ, হয়তো বুড়ো বয়সে ফুটবল খেলতে গিয়ে অনভ্যস্ত পা মচকে যাওয়া, পুকুরের জলে মাছ ধরতে গিয়ে জল আর গরম মিলে সর্দিজ্বর—সবকিছুতেই আনন্দ। এটুকুর জন্যই পথের শত বাধা পেরিয়ে ছুটে যাওয়া। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার তাই এতো তাড়া।

পাশের দেশ ভারতের কলকাতার উৎসবে এই চিত্র কিন্তু দেখা যায় না। প্রচুর মানুষ কলকাতা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে দুর্গাপূজার সময়, এমন দেখা যায় না। এই পার্থক্যটা কেন হয়?

সম্ভবত কারণ এই যে, কলকাতার প্রচুর অধিবাসীর 'দেশের বাড়ি' বলে কিছু নেই। তারা কলকাতারই মানুষ। কলকাতার প্রচুর মানুষ দেশভাগের ফল হিসেবে ওখানে গেছেন। শেকড়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আর নেই। আর কলকাতায় কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কলকাতায় যারা ভাড়া থাকেন, তারাও বলতে গেলে বংশপরম্পরায় একই বাড়িতে থাকেন। বাড়ির মালিক চাইলেই তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পারেন না। এমনকি তার নিজের প্রয়োজনে ঘরটি দরকার হলেও আদালতে যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যায় না। বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইনে এমন বিধান রয়েছে। সুতরাং শহরের একটা বাড়িতেই, সেটা ভাড়া হলেও, শৈশব-কৈশোর কেটেছে নগরের যে বাসিন্দার, সে শেকড়ের সন্ধান করতে আর কোথায় যাবে।

ঢাকায় চিত্র আলাদা। ঢাকা পুরনো শহর হলেও ঢাকার বাসিন্দারা অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের নগরবাসী। তাদের ছেলেবেলা গ্রামে, ছোট শহরে। সেই স্মৃতি আছে। যাওয়ার জায়গা আছে। নিজেদের বাড়ি আছে এমন মানুষ বাদ দিলে ঢাকায় বড় হওয়া মানুষের একক মহল্লা বা বাড়িতে বড় হওয়ার স্মৃতি নেই। শেকড় খুঁজতে তাকে মা-বাবার গ্রামের বাড়িতেই যেতে হয়।

সুতরাং ভিড়টা হয়। উৎসবের সময় রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। সেটাকে কত ভালোভাবে ম্যানেজ করে নাগরিকদের এই যাত্রাকে আনন্দময় ও নিরাপদ করে তোলা যায়, সেটা দেখাই কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

তাপস বড়ুয়া, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
IMF suggestions for Bangladesh

IMF suggests raising power, gas and fertiliser prices

The International Monetary Fund yesterday recommended reducing government subsidies by hiking prices of power, gas and fertiliser, and spending the saved money on society safety net programmes.

16h ago