জিডিপি, মাথাপিছু আয় ও টিসিবির ট্রাকের সামনে দীর্ঘ লাইন

জিডিপি বাড়ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। টিসিবির ট্রাকের সামনে ভিড়ও বাড়ছে। মন্ত্রী বলেছেন, ভালো পোশাক-আশাক পরা মানুষেরাও টিসিবি থেকে পণ্য কিনছেন। সামান্য কম দামে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্য কেনার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার ট্রাকের সামনে ভিড়টা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, করোনার থাবায় ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি (পিপিআরিসি-বিআইজিডির জরিপ)।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এই যে জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে তাতে সাধারণ মানুষের লাভ কী হলো!
মনে করে নেওয়া যেতে পারে, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের এক মধ্যরাতে ঘড়িতে তারিখ পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হয়ে যায়। এর আগের বছর পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে ছিল আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি।
বিবিসি তখন তাদের রিপোর্টে লিখেছিল, নাইজেরিয়া তাদের জিডিপির উপাত্ত 'রি-বেজড' করেছে বা ভিত্তি পুনঃসঙ্গায়িত করেছে। ফলে এই রাতারাতি পরিবর্তন। নাইজেরিয়ার আর্থিক খাত বিশ্লেষক বিসমার্ক রিওয়ানে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এটাকে একটা 'ভ্যানিটি' বলে উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, 'এই ঘোষণার জন্য নাইজেরিয়ার মানুষ আগামীকাল থেকে আগের চেয়ে ভালো থাকবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এর মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা বেড়ে যাচ্ছে না, মানুষের পেটে আগের চেয়ে বেশি খাবার যাচ্ছে না। এটা কোনো কিছুকেই বদলে দেয়নি।'
আসলে কী ঘটেছিল? সেবার নাইজেরিয়ার জিডিপির হিসাবে কতকগুলো খাতকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেগুলো আগে জিডিপির হিসাবের মধ্যে ধরা হতো না।
নাইজেরিয়ার সরকার নতুন করে অন্তর্ভুক্ত যেসব খাতের কথা উল্লেখ করেছিল তার মধ্যে ছিল টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি, সংগীত, অনলাইন বিপণন, উড়োজাহাজ পরিসেবা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ। এগুলো দেশে ছিল; জিডিপির হিসাবের খাতায় ছিল না। সুতরাং এগুলোকে হিসাবে ঢুকানোয় জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে। তবে তাতে সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন করে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।
জিডিপির ভিত্তি নতুন করে সঙ্গায়ন বা 'রি-বেসিং' দরকার হয় একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য। তাছাড়া জিডিপি বাড়লে সরকার গর্ব করতে পারে, সেটা তো আছেই। আরেকটা কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের চাপ থাকে এটা করার জন্য। কারণ, তারা সহায়তার পরিমাণ ও ক্ষেত্র সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অর্থনীতির সর্বশেষ ছবিটা দেখতে চায়।
কয়েকদিন ধরে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। আসলেই মানুষের জীবন জেরবার। ঘোষণা দিয়ে এবং ঘোষণা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির কাছে মানুষ জিম্মি।
মন্ত্রী যাদেরকে 'ভালো পোশাক পরা' মানুষ বলছেন, তারা কেন টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার দরকার আছে। দরকার না থাকলে কেউ চাল-ডাল-তেল কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। অন্য দোকানের সঙ্গে টিসিবির ট্রাকের পণ্যমূল্যের দিক দিয়ে যে সামান্য পার্থক্য সেটা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই তারা সময় ব্যয় করে সেখানে দাঁড়াচ্ছেন।
যদি বলি জিডিপি যে বেড়ে গেলো, মাথাপিছু আয় যে বেড়ে গেলো, তার কী প্রভাব পড়লো তাহলে। ভেবে দেখা দরকার, জিডিপি কেন বাড়ে, কীভাবে বাড়ে। মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসে এরকম বছর বছর জিডিপি বাড়তো না। মানুষের জীবন ছিল অতি দরকারি জিনিস দিয়ে জীবন চালানোর জীবন বা 'সাবসিস্টেন্স লাইফ'।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে প্রথম একটা ঘটনা দেখা যায় যে অর্থনীতি বড় হতে শুরু করেছে, পারিশ্রমিক বাড়ছে। মানুষ 'না হলেও জীবন চলতে পারে' এমন দু-একটা জিনিস কিনতে শুরু করেছে। তখন এইসব পণ্যের মধ্যে ছিল হয়তো একটা আয়না বা চিরুনি, একটা বাড়তি অন্তর্বাস বা একজোড়া জুতো। সুতরাং মানুষ বেশি খরচ করছে, তাতে ব্যবসা বাড়ছে; ব্যবসা বাড়লে কর্মীর পারিশ্রমিক বাড়ছে; ফলে মানুষ আরও বেশি খরচ করতে পারছে।
মানুষ যখন একান্ত প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি জিনিস কিনতে শুরু করলো, তখনই অর্থনীতির আকার বড় হতে শুরু করল, জিডিপি বাড়তে শুরু করলো। টিকে থাকার জন্য দরকার নেই, কিন্তু 'পেলে মন্দ হয় না' এরকম জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়ই অর্থনৈতিক 'গ্রোথে'র মূল শর্ত।
এবার একটু চারপাশে তাকাই, নিজের দিকে তাকাই। এক মাসে কয়টা জিনিস আমরা কিনি যেটা একান্তভাবেই দরকার, আর কয়টা কিনি যেগুলো না হলেও দিন চলে যেতে পারে। কোন ধরনের জিনিসের জন্য কত টাকা আমরা খরচ করি। এরমধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে, কোনটা আসলেই না হলে চলবে না, আর কোনটা না হলে চলবে না বলে আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, নতুন লাইফস্টাইল দেখানোর মাধ্যমে।
এই যে এটাও দরকার; না হলে জীবনে কী হলো—এই ব্যাপারটা এতোদূর পর্যন্ত গেছে যে 'পাখি ড্রেস' (কলকাতার একটি টিভি সিরিয়ালের মূল চরিত্রের পরা পোশাক) না কিনতে না পারায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। মোবাইলের নতুন ভার্সন কেনার জন্য মানুষ কিডনি বিক্রি করেছে এমন খবরও আছে। অথচ ফোনের নতুন ভার্সনের কয়টা নতুন ফিচার সে আসলেই ব্যবহার করবে।
বিলাসদ্রব্য কেনা ও ব্যাবহারের সঙ্গে সামাজিক সম্মানের ব্যাপারটি আরোপ করে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে গেছে। ও এটা করে, এটা পরে, আমি যদি সেটা না করি, না পরি সেটা তাহলে আমার মানটা থাকে কোথায়?
রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ছবি তোলা, ফেসবুকে পোস্ট, লাইক কমেন্ট এগুলো এখন প্রয়োজনীয় জিনিস বলে মনে হয় অনেকের কাছে। মাসের শেষ, পকেটে টাকা নেই, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খালি। সমস্যা নেই, আছে ক্রেডিট কার্ড। ধার করো ইচ্ছেমতো। সময়মতো শোধ না দিতে পারলে উচ্চহারে সুদ দাও।
ঋণ করে ঘি খাওয়ার যে কথাটি সমাজে আগে থেকে প্রচলিত ছিল, ক্রেডিট কার্ড ব্যাপারটা সেটাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। একদিকে ঋণের চিন্তা, আরেকদিকে শেখানো 'ফিল গুড' এর ধারণা।
আপনার সামর্থ্য নেই এক বোতল শ্যাম্পু কেনার, আছে মিনিপ্যাক। ওই বোতলের শ্যাম্পু সবটুকু আপনি কিনবেন কয়েকবারে ভাগ করে। চুল কাটাতেন মোড়ের দোকানে ৫০ টাকা দিয়ে, ইচ্ছে হবে একদিন জেন্টস পার্লারে যাই, চুল কাটালেন ৩০০ টাকা দিয়ে। বিলাসপণ্য ও বিলাসসেবার এই বাজার পরিকল্পিতভাবেই তৈরি করা। এর ওপরেই টিকে থাকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা।
এই যে প্রচুর পণ্য কেনা-বেচা, এর মধ্য দিয়েই বাড়ে জিডিপি। আপনি ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ধার করলেন, এখানে ১০০ টাকার লেনদেন হলো। সেই টাকা দিয়ে স্যান্ডউইচ খেলেন, এখানে ১০০ টাকার লেনদেন হলো। সেই রেস্টুরেন্টের মালিক সেই ১০০ টাকা কর্মচারীকে পারিশ্রমিক দিলেন, এখানেও ১০০ টাকার লেনদেন হলো। কর্মচারী বাড়ি ফেরার পথে ১০০ টাকা দিয়ে বাজার করলেন, এখানে ১০০ টাকার লেনদেন হলো।
এভাবে চলতেই থাকবে। টাকা সেই ১০০। কিন্তু যতবার সেটা হাতবদল হবে, ততবার সেটা জিডিপিতে যোগ হবে। এইভাবে দেশের জিডিপি বাড়বে, ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হলেও।
'মাথাপিছু আয় মাথার পিছন দিয়ে যাচ্ছে, তাই টের পাচ্ছি না'—এরকম একটা রসিকতাপূর্ণ পোস্ট ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। মাথাপিছু আয় তো মোট আয়কে মোট মানুষের সংখ্যা দিয়ে গড় করা হিসাব।
সুতরাং একজন একটাও টাকা নেই বলে না খেয়ে থাকলে আর অন্যজন ১ কোটি টাকার মালিক হলে ১ জনের গড় হবে ৫০ লাখ টাকা। তাতে প্রথম ব্যক্তিটির পেটে খাবার পড়বে না, এটাই স্বাভাবিক হিসেব।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে গড় আয় বেড়ে যাচ্ছে সেটার কোনো সুফল দরিদ্র মানুষের ঘরে কি পৌঁছে দেওয়া যায় না? সম্পদের সুষম বণ্টন অথবা অন্তত কিছুটা ন্যায়ানুগ বণ্টন কি একেবারেই অসম্ভব? যে ব্যক্তি বেশি আয় করছে, তার হয়তো চ্যারিটি করার 'নৈতিক দায়' আছে। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার তো নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করার 'বাধ্যবাধকতা' রয়েছে।
আমেরিকায় মন্দার সময় যখন মানুষের হাতে টাকা ছিল না অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক হায়েক পরামর্শ দিয়েছিলেন অর্থনীতি যতই বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক, এই পরিস্থিতিতে সরকারকে অর্থনীতিতে টাকা 'ইনজেক্ট' করতে হবে। হুভার ড্যামের মতো বড় প্রকল্প নিয়ে মানুষের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
আমাদের দেশেও বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি আমরা মালয়েশিয়া বা ভারতের চেয়ে অনেক বেশি খরচ করি। আবার কোনো কোনো নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশও দেওয়া হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনারের দুর্নীতি সূচকে আমরা প্রথম সারিতে। দেশে যে দুর্নীতি আছে, এটা বোঝার জন্য বিদেশি সংস্থার জরিপ না দেখলেও চলে। আমরা তো এই দেশেই থাকি, এই সমাজেই চলাফেরা করি। না বোঝার কিছু নেই।
দুর্নীতির মাধ্যমে একদল মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিকে কোনো না কোনোভাবে অপব্যবহার করে প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে। তাদের সঙ্গে টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো মানুষের বা ভাতের বদলে প্রাইভেট পড়াতে চাওয়া যুবকের সম্পদের গড় যে হিসাব তাতে ব্যক্তি মানুষটির কিছু যায় আসে না।
দুর্নীতি কমিয়ে এবং জনমুখী আর্থিক নীতিমালা গ্রহণ করার মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সুবিধাটা সবার মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
তাপস বড়ুয়া, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments