টিকটক বন্ধ সমাধান নয়, দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি

টিকটক আর লাইকির বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু দেখতাম ফেসবুকে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা টিকটকে নানান মজার ভিডিও শেয়ার করছে তাদের নিজেদের, বন্ধু-বান্ধবের আড্ডার অথবা পোষা পশুপাখির।
ছবি: সংগৃহীত

টিকটক আর লাইকির বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু দেখতাম ফেসবুকে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা টিকটকে নানান মজার ভিডিও শেয়ার করছে তাদের নিজেদের, বন্ধু-বান্ধবের আড্ডার অথবা পোষা পশুপাখির।

ভাইরাল হওয়া সুন্দর সুন্দর নাচ ও গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে হাসির ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করা যায় এই টিকটক অ্যাপে। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে এই অ্যাপ খুবই জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর চাহিদা মতো যেকোনো কিছুর সঙ্গে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে ছোট-ছোট ভিডিও তৈরি করে তা শেয়ার করা যায়।

হঠাৎ ফেসবুকে দেখা গেলো একটি মেয়েকে নির্মমভাবে নির্যাতন করার কাহিনী। মেয়েটিকে নানা কায়দায় অত্যাচার করে, সেটাকে ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছে। গত মে মাসের শেষে ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও দুই দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রীতিমত ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। এরপর টিকটকের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ভারতে পাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ ঘটনা, সংবাদমাধ্যমে আসার পর সবাই নড়েচড়ে উঠেন।

আমরা যারা অভিভাবক, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিক বা অন্য পেশাজীবী তারা আদতে কেউই জানতাম না যে টিকটক ও লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে নারী পাচারকারীদের এত বড় একটা র‌্যাকেট ৮/১০ বছর ধরে সক্রিয় আছে। অনলাইনে ওই ঘটনা প্রকাশিত না হলে আমরা হয়তো কেউ জানতেই পারতাম না আমাদের ছেলে-মেয়য়েরা কোন পথে হাঁটছে।

টিকটক ও লাইকির এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অল্প বয়সের সুন্দর চেহারার মেয়েদের বলা হয় তাদের টিকটক ‘স্টার’ বানিয়ে দেওয়া হবে, ফলোয়ার বাড়বে, টাকা আয় করা যাবে। পরে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে নেওয়া, পাচার করে দেওয়া, ধর্ষণ, আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।

আমরা জানতেই পারিনি কিভাবে মেয়েরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, কিভাবে তারা ভারত, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাচ্ছে? সীমান্ত পার হওয়ার পরপরই তাদের ওপর শুরু হয় যৌন নিপীড়ন।

এই ঘটনার পর আমরা ক্রমশ জানতে পারলাম একজন টিকটক ও লাইকি ব্যবহারকারীর যখন এক হাজারের বেশি ফলোয়ার হয়, তখন সে তার ভক্তদের জন্য লাইভে আসতে পারে। ২০১৯ সালের শুরু থেকেই ডাউনলোড চার্টের শীর্ষের কাছাকাছি অবস্থান করছে টিকটক।

ইকোনমিক টাইমস পত্রিকা লিখছে, প্রতিমাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছেন। বিশ্বজুড়ে এই অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি। আর লাইাকি হলো ছোট ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করে নেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম। লাইকির আছে অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ বৈশিষ্ট্য। ফলে এর ব্যবহারকারীরা বাবা-মা ও অভিভাবকরা কখনোই সন্তানের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারবেন না বা জানবেন না যে তাদের ছেলে-মেয়েরা কী করছে।

বাংলাদেশে লাইাকির চেয়ে টিকটক এগিয়ে। বেশির ভাগ টিকটকার কম বয়সী। লাইকি ও টিকটকের জন্য খুব সামান্য সেটআপ ও দক্ষতা দরকার হয় বলে স্বল্প শিক্ষিত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও খুব সহজেই সাইবার-বিনোদন জগতে প্রবেশ করতে পারে। শুধু একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন হয়।

এছাড়া, এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে তেমন কোনকিছুর দরকার হয় না। টিকটকের রিপোর্টিং সিস্টেমে অশ্লীল বিষয় বা আধেয়কে আলাদা করে দেখানো হয় না বলে যে যা খুশি আপলোড করতে পারে।

ঘটনা সমানে আসার পর এ সবের নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে। জনপ্রিয় কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই বাংলাদেশে নিবন্ধিত নয়। শুধু ভ্যাট নিবন্ধন করে পুরো সমস্যার সমাধান করা যাবে কি? এতবড় একটা গ্রুপ যাদের ডালপালা বাংলাদেশ, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে, তাদের কথা পুলিশ এত বছরেও জানলো না কেন?

এই ভিডিও ভাইরাল না হলে মানবপাচারের এই ঘটনা কি আদৌ কখনো সংবাদ শিরোনামে আসত? পুলিশের চোখ, সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে কিভাবে তারা এতদিন সীমান্ত দিয়ে পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল? আটককৃত ব্যক্তি র‌্যাবকে জানিয়েছে, গত ৫ বছরে অন্তত ৫০০ মেয়েকে তারা পাচার করেছে। তাদের বয়স ১৮ বছর থেকে ২২ বছরের মধ্যে। গত আট বছরে তারা অন্তত এক হাজার নারীকে পাচার করেছে।

অনেকেই বলছেন, এসব অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হোক। টিকটক-লাইকি বন্ধ করে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেছেন, ‘টিকটক, ফেসবুক, লাইকি— এগুলো বিটিআরসি চাইলেই বন্ধ করতে পারে না। কারণ, যে কেউ এসব প্ল্যাটফর্মে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। তবে আমরা মনে করি, এ বিষয়ে সমাজের সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সময় প্যারেন্টাল গাইডলাইন অভিভাবকদেরও পড়া উচিত।

বিটিআরসি ইতোমধ্যেই টিকটক ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে আপত্তিকর কনটেন্টগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য। তারা বলেছে, তারা যথা সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে খুব দ্রুত চালু করতে যাচ্ছে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর)। এর মাধ্যমে মোবাইল সেট ব্যবহারকারীর পরিচয় জানা যাবে। তাতে করে কেউ কারো সেট বা সিম কার্ড ব্যবহার করতে পারবে না।

দেশে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার: নারী ও মেয়েশিশুদের পাচার রোধে করণীয়’ বিষয়ে এক ওয়েবিনারে তিনি এ কথা বলেছেন। সেখানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, ‘প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যে এভাবে নারী পাচার কার্যক্রম চলছে, তা বুঝতে আমাদের দেরি হয়ে গেছে। আমরা মনে করেছিলাম এসব অ্যাপ দুনিয়াব্যাপী যেভাবে ফান হিসেবে চলছে, এখানেও সেভাবেই চলছে। কিন্তু, পরে দেখলাম তরুণদের একটা গ্রুপ সংগঠিত হয়ে অপরাধ করছে এগুলো ব্যবহার করে। এখন আমরা তা ঠেকানোর চেষ্টা করছি।’

সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা সবাই বলেছেন, এটি একটি জটিল সামাজিক সমস্যা। আইন দিয়ে বা পুলিশি তৎপরতা চালিয়ে একে ঠেকানো যাবে না। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, সেই সঙ্গে সন্তানদের সচেতন করতে হবে।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অবশ্যই দেশের গণমাধ্যম, অভিভাবক ও বিশেষ করে কিশোরী-তরুণীদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক সবাইকে ওভার সেক্সুলাইজেশন বিষয়টি বুঝতে হবে। কেন একটা বয়সে পৌঁছানোর আগেই মেয়েরা বেশি সাজতে চাচ্ছে, কেন ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে? এটা করতে গিয়ে তারা নানান অ্যাপ ব্যবহার করছে। অ্যাপ ব্যবহার করা তো অপরাধ নয়, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে যখন তারা পাচার হয়ে যায়, ফাঁদে পড়ে তখনই সেটা অপরাধ।

অপরাধী চক্র অনেক বেশি দক্ষ। বিদেশে ধরা পড়ার কারণে অপরাধীদের শাস্তির প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ এবং চ্যালেঞ্জটা এখানেই। তাছাড়া, যে মেয়েগুলো ফিরে আসে তাদের নিরাপত্তা কোথায়? তাদেরকে কতদিন সেফ হোমে রাখা সম্ভব? প্রযুক্তি বন্ধ করা অসম্ভব। তাই চেষ্টা করতে হবে কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানো যায়। জাতীয় থেকে গ্রাম পর্যায়ে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে, কারণ কোন জায়গাই সন্তানদের জন্য নিরাপদ নয়।

টিকটক অ্যাপ ভারতে বন্ধ করে দিয়েছে গুগল ও অ্যাপল। মাদ্রাজ হাইকোর্টের এক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে টিকটক বন্ধ করা হয়েছে। সে দেশে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ ইতোমধ্যে টিকটক ডাউনলোড করেছে। অ্যাপটি ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি ছড়ানো হচ্ছে এমন উদ্বেগ তৈরি হওয়ার পর অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটক অ্যাপ সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। অ্যাপটির মালিক প্রতিষ্ঠান আদালতে বলেছে যে আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়ে নেবে এবং নিয়েছেও।

এই ব্যবসায় জড়িত হোতাদের চিহ্নিত করতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ইন্টারঅ্যাকশনসের মনিটরিং বাড়াতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়াতে হবে। চার/পাঁচ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ২০/২২ বছরের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে প্রযুক্তিতে আসক্ত। অভিভাবকদের এ দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এসব অ্যাপের বিপদ সম্পর্কে অভিভাবক ও কিশোরী-তরুণীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সীমান্ত এলাকায় দৃষ্টি বাড়ানো, ভারত সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে জোরদার কথা বলা, পুলিশের পাশাপাশি সব সংস্থা ও এনজিওগুলোকেও কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে। কর্তৃপক্ষকে একটি সচেতনতামূলক দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে বাবা-মা, অভিভাবক, শিশু থেকে তরুণ সবাইকে ইন্টারনেটের বিপদ, অনলাইন বন্ধুত্ব ও অনলাইন প্রাইভেসি সম্পর্কে জানানো হবে। নয়তো এমন অপরাধ আরও বাড়তেই থাকবে, অন্য কোনো উপায়ে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Sundarbans fire: Under control, not entirely doused yet

Sundarbans: All fires in 23 years were confined to only 5pc area

All fires in the Sundarbans over the last 23 years took place in just five percent area of the mangrove forest under the east forest division, said officials concerned.

17h ago