ডক্টর-ডাক্তার: জয় হারুন-সেলিমদের!

ডক্টর কামাল সাব কিসের ডাক্তর? মিরপুরে তার একটা ডিসপেনসারিও আছে? কাউরে কখনো একটা জ্বরের ট্যাবলেটও দিছে এই ডাক্তরে?

ডক্টর কামাল সাব কিসের ডাক্তর? মিরপুরে তার একটা ডিসপেনসারিও আছে? কাউরে কখনো একটা জ্বরের ট্যাবলেটও দিছে এই ডাক্তরে?

প্রশ্নগুলো ছিল ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তখনকার ঢাকা-১১ আসনে নৌকার প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে ধানের শীষের প্রার্থী আলহাজ হারুন মোল্লার।

যদিও এ বাক্যগুলো খবরের বাজারে মিরপুরের আরেক নেতা এস এ খালেকের মন্তব্য হিসেবেও প্রচারিত।

ড. কামাল সম্পর্কে আরও নানান কথা বলে তখন আলোচিত হয়েছিলেন হারুন মোল্লা। রসিয়ে রসিয়ে তার এসব কথায় মানুষ বিনোদিত হয়েছে। নির্বাচনের মাঠে নামও ফেটেছে হারুন মোল্লার।

এতে গা মাখেননি ড. কামাল। হারুন মোল্লার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও প্রশ্নের একটি জবাবও দেননি ড. কামাল হোসেন। এতে শিক্ষিত মহলে তার প্রশংসা হলেও নির্বাচনী মাঠে তিনি লুজার হন। আর লাভবান হন হারুন মোল্লা। ড. কামালকে ২ হাজার ১৩৬ ভোটে হারিয়ে এমপি হন তিনি। হারুন মোল্লা পেয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৮৮৬ ভোট, আর ড. কামাল হোসেন ৪৭ হাজার ৭৫০ ভোট।

কোনো প্রতিবাদ বা অনাস্থা না জানিয়ে ওই ফলাফল মেনে নেন ড. কামাল। প্রায় ৩১ বছর পর আবারও ডক্টর-ডাক্তার বিষয়ক হালকা কথা।

ড. ইউনূস কিসের ডাক্তার? পশুর, না মাছের, না গরুর?—সংসদে জানতে চেয়েছেন শেখ সেলিম।

ডক্টর কামাল হোসেনকে ঘায়েল করতে ১৯৯১ সালে  হারুন মোল্লার স্থূল কথা ছিল নির্বাচনী মাঠে, অলি-গলিতে। এবার শেখ সেলিম তা করলেন খোদ জাতীয় সংসদে। তখনকার কর্তা একজন স্থানীয় নেতা হারুন মোল্লা। এবার শেখ সেলিমের মতো জাতীয়, তথা বনেদি নেতা। তাও আবার শেখ পরিবারের হাই-প্রোফাইল নেতা। মোটেই হারুন মোল্লা পর্যায়ের ডক্টর-ডাক্তারের তফাৎ না বোঝা নেতা নন শেখ সেলিম। তিনি গড়পড়তা বা যেনতেন শিক্ষিত নন। উচ্চশিক্ষিত। তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রয়েল সাবজেক্টে।

খুলনার নামকরা সেন্টজোসেফ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি ও ঢাকার টেকনিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এইচএসসি, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সারে বিএসসি। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে ডিপ্লোমা ইন স্ট্যাটিসটিক্স ডিগ্রি। এ পর্যন্ত সংসদ সদস্য হয়েছেন ৭-৮ বার, মন্ত্রীও ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে তিনি। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মামাতো বোন। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের কাকাসহ আরও কতো পরিচিতি-খ্যাতি তার।

সংসদে মুরুব্বি পর্যায়ের কেউ তাকে একটু বারণও করেননি। বরং টেবিল চাপড়িয়ে বাহবা দিয়েছেন। বক্তব্যের পর জয়তু–জয়তু দিয়ে হ্যান্ডশ্যাক করেছেন। হাত নেড়ে ধন্যবাদ দিয়েছেন। না বললেই নয়, এই সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিনও একজন ডক্টর। তারও কি খারাপ লাগেনি? তিনি শেখ সেলিমকে বাধা দেননি, বারণও করেননি। ডক্টর-ডাক্তারের তফাৎটা বাতলে দেননি। এটাই বাস্তবতা।

প্রচুর পরিমাণে তুই-তোকারিও ছিল শেখ সেলিমের বক্তব্যে। তার কোনো বক্তব্য বা শব্দ স্পিকার এক্সপাঞ্জ করেছেন বলে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য নেই। ধরেই নেওয়া যায় সংসদের রেকর্ডে তা থেকে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে, এ দেশে একসময় একজন নোবেল জয়ী ড. ইউনূস ছিলেন এবং মহান সংসদে কী দশা করা হয়েছিল তাকে?

সংসদে সেদিন মোটেই ড. ইউনূস সাবজেক্ট ছিল না। শেখ সেলিমের বক্তব্য ছিল প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা। সেই সাধারণ আলোচনায় এমন অসাধারণ মানের বক্তব্য জরুরি ছিল না। কিন্তু, পদ্মা সেতু সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইউনূসকে প্রাসঙ্গিক করে ফেলা হলো। তাও নিম্নমানের শব্দ ও ভাষায়। ইউনূস কবে, কোথায় পদ্মা সেতু নির্মাণে বিরোধিতা করেছিলেন; বা এমন কিছু বলেছেন, যা থেকে ধারণা করা যায় তিনি পদ্মা সেতু হোক, তা চাননি—এ সংক্রান্ত তথ্য দিলেও বক্তব্যটির ভ্যালু থাকলেও থাকতে পারতো।

প্রমাণ যদি এমন হয় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আর কী লাগে? প্রধানমন্ত্রী বলা মানেই প্রমাণ। ডক্টর ইউনূসও কখনো প্রতিবাদ করেননি। ভবিষ্যতে করবেন সেই লক্ষণও নেই। মানে মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ!

বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বিশাল অংশ বন্যায় ভাসছে। সামনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন। এমন সময়ে ড. ইউনূসকে লক্ষবস্তু করে কী বড় কোনো অর্জনের সম্ভাবনা আছে? এ প্রশ্নের জবাব আছে কেবল ড. ইউনূসকে তুলাধুনাকারীদের কাছেই।

বাংলা ভাষাকে বিশ্বের কাছে চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি জাতিকে বিশ্বের কাছে চিনিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আর আধুনিক বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল জয়ী ডক্টর ইউনূস সুদখোর, ঘুষখোর, অর্থপাচারকারি এবং পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধচারী, দেশদ্রোহী হয়ে গেলে আমাদের আর থাকলো কী?

একে একে আমরা সব বরবাদ করে ফেলছি। জ্ঞানীদের কথা হচ্ছে, সবকিছু খুলতে নেই। এতে আর সৌন্দর্য অবশিষ্ট থাকে না। একটি ফুলও কিন্তু তার সবকিছু খোলে না। হারুন-সেলিমদের দিয়ে ফুলের সবকিছু খুলে এর রূপ-সুধা নষ্ট করা কেবল দুঃখজনক নয়, বিকৃত আনন্দের নামান্তরও।

কখনো কারো ভালো কাজের প্রশংসা করতে না পারা নিজের দৈন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গবেষকদের কাছে এটি এক ধরনের বাতিক। কারো কারো অন্যতম মানসিক সমস্যা, অন্যকে ছোট করা। এ সংকটে আক্রান্তরা মানসিক রোগী কিনা, তা নির্ধারণ করা মনোবিজ্ঞানের গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়। ইংরেজিতে বুলিং নামে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। তবে বুলিংয়ের বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যিনি বাজে মন্তব্যটি করছেন তাকে অপরাধী হিসেবে দায়ী করা হয় এবং বুলিং বা বাজে মন্তব্যের শিকার যে তার খারাপ লাগার বিষয়টিকে প্রধান করে দেখা হয়। অবশ্যই এই বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু এর পেছনে ক্রিয়াশীল থাকা প্রত্যয়গুলোও ভীষণ গুরুত্ববহ।

অন্যকে ছোট করে কথা বলে, অপমান করে, কষ্ট দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া সুস্থ মস্তিষ্কের পরিচয় নয়। মান হারানোর ভয়ে কেউ জবাব না দিলেও কথা কিন্তু থেকে যায়। কষ্টের কথা তারা প্রকাশ্যে না বললেও কিন্তু বলা হয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে। এর জের আছে। বাংলায় হেনস্তা করা ক্রিয়াবাচক শব্দটি এ ক্ষেত্রে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই অনেকে অন্যকে ছোট করা বা অপমান করাকে একটা আনন্দের পর্যায়ে নিয়ে যান। নিম্নমানের বচন-বাচনে কখনো নিজে অপমান করেন, কখনো অন্যকে দিয়ে করান, এতে তারা কেন এতো সুখ-স্বস্তি পান?—তা গবেষণার বিষয়।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

PUST postpones Turkey lift-inspection tour

The Pabna University of Science and Technology (PUST) today postponed a tour of Turkey, which was set to be undertaken by a six-member team to inspect lifts, after the president told the university to do so

4h ago