ডেকের যাত্রীদের জীবন মূল্যহীন!

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নদীবেষ্টিত দক্ষিণের জেলাগুলো। এ অঞ্চলের মানুষও তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। তাদের আয়ের প্রধান মাধ্যম কৃষি কাজ। এ ছাড়া একটি বড় অংশ জীবিকা নির্বাহ করে বঙ্গোপসাগর ও স্থানীয় বিভিন্ন নদীতে মাছ ধরে। যুগের পর যুগ ধরে তারা এভাবেই পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
লঞ্চের ডেকে যাত্রী পরিবহনের নিয়মিত চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নদীবেষ্টিত দক্ষিণের জেলাগুলো। এ অঞ্চলের মানুষও তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। তাদের আয়ের প্রধান মাধ্যম কৃষি কাজ। এ ছাড়া একটি বড় অংশ জীবিকা নির্বাহ করে বঙ্গোপসাগর ও স্থানীয় বিভিন্ন নদীতে মাছ ধরে। যুগের পর যুগ ধরে তারা এভাবেই পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস। এতে করে পরিবর্তন এসেছে দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নআয়ের এসব মানুষের। পূর্ব পুরুষের পেশা পরিবর্তন করে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বড় শহরগুলোতে। সেখানে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ডে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছেন নারীরা। তাদের কাজের প্রধান ক্ষেত্র গার্মেন্টস শিল্প।

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ অনেকটা সহজলভ্য। আগে এ অবস্থা ছিল না। ফলে বরিশাল, ঝালকাঠি, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার মানুষ বাসের চেয়ে বেশি লঞ্চে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে অভ্যস্ত। এর অর্থনৈতিক একটি দিকও রয়েছে। লঞ্চে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের পাশাপাশি মালামাল পরিবহনও অনেক সহজ। আর যাতায়াতের সহজ এ মাধ্যমটি বেশি ব্যবহার করেন নিম্নআয়ের মানুষ।

এ দিকে পিছিয়ে নেই উচ্চবিত্তসহ দেশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরাও। দক্ষিণাঞ্চলে কোনো কাজের জন্য কিংবা বেড়াতে গেলে লঞ্চে না চরলে যেন যাত্রা অতৃপ্ত থেকে যায়।

দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চ যাতায়াত নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক নাটক ও সিনেমা। এ ছাড়া প্রতিদিন খুব ভোরবেলা কিংবা বিকেলে ঢাকার সদরঘাটে কিংবা মাঝ রাতে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে দেখলে বোঝা যায় দক্ষিণাঞ্চলের কত মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন।

দেশের সড়ক ব্যবস্থা উন্নত হলেও লঞ্চ ব্যবসা সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। মানুষের চাহিদায় লঞ্চ ব্যবসায়ীরা নিয়মিতই তৈরি করছেন বিলাসবহুল লঞ্চ। তবে পরিবর্তন আসেনি লঞ্চের নীচতলায় ডেকে ভ্রমণ করা যাত্রীদের অবস্থার। অনেকটা গোয়াল ঘরের মতো এক জায়গায় যত বেশি সম্ভব যাত্রী পরিবহন করা হয়।

লঞ্চে নেই কোনো শৃঙ্খলাও। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার চিত্র তো আরও ভয়াবহ। লঞ্চের ছাদেও যাত্রীদের তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। এরপরও কখনো লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলে না যে আর যাত্রী নেওয়া যাবে না। বরং মাইকে উচ্চ শব্দে যাত্রীদের আহ্বান করে লঞ্চে ওঠানো হয়। বিশ্বের আর কোনো দেশে এ ধরণের চিত্র দেখা যায় কি না জানা নেই। ডেকের যাত্রীদের জন্য নূন্যতম কোনো সুযোগ-সুবিধা তো থাকেই না, তাদের সংখ্যারও কোনো তথ্য থাকে না লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে। শুধুমাত্র লঞ্চের ভাড়া সংগ্রহের জন্য তাদেরকে একটি টিকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে থাকে না কোনো নাম বা ঠিকানা।

আর যখনই বড় ধরণের কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে তখনই বেগ পেতে হয় উদ্ধার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। তারা নির্দিষ্ট করে দূর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের যাত্রী সংখ্যা বা তাদের পরিচয় বলতে পারে না। এমনটাই কি হওয়া উচিত?

গত ২৪ ডিসেম্বর ভোররাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ডেকের যাত্রীদের জীবন কতটা মূল্যহীন। ওই লঞ্চে কতজন যাত্রী ছিলেন কিংবা তাদের পরিচয় কি তার কিছুই বলতে পারেনি প্রশাসন। এমনকি কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তারও কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। হয়ত নূন্যতম তথ্যটুকু থাকলে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারত তাদের প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষটির অবস্থা কী। অথবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো। পাশাপাশি যেখানে যাত্রীদের দাবি ওই লঞ্চে দেড় হাজারের মতো যাত্রী ছিল, সেখানে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলেন প্রায় সাড়ে ৩০০ যাত্রী ছিল। একটি শৃঙ্খলা থাকলে হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দেওয়া যেত। যারা প্রতিনিয়ত লঞ্চের ডেকে যাতায়াত করেন, তারাই কেবল বুঝতে পারবেন কর্তৃপক্ষের এ তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।

লঞ্চ কর্তৃপক্ষ টাকার জন্য কতটা মরিয়া তা লঞ্চে যারা ভ্রমণ করেন শুধুমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারেন। অনেক সময় কেবিনের যাত্রীদেরও পড়তে হয় চরম বিড়ম্বনায়। হঠাৎ করেই মাঝ রাতে দরজা খুলে দেখতে পান কেবিনের সামনে কেউ বিছানা পেতে ঘুমিয়ে আছেন। হয়ত মানবিক কারণেই তাদেরকে কিছু বলেন না। কিন্তু এটা কি একটা পরিবহনের চিত্র হওয়া উচিৎ?

আমরা জেলার ভেতরে চলাচলকারী বাসে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের চিত্র হরহামেশাই দেখতে পাই। কিন্তু সেটা দূরপাল্লার পরিবহনের ক্ষেত্রে দুর্লভ। তাহলে দূরপাল্লার লঞ্চে কেন এমন চিত্র থাকবে? হয়ত উত্তরটা এমন হতে পারে যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এমনটা করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত লঞ্চের ভিআইপি কেবিনগুলোতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা যাতায়াত করেন। কখনো কি তাদের নজরে আসে না এই বিশৃঙ্খলা?

নজরে হয়ত অনেক কিছুই পড়ে। হয়তো কোনো বিশেষ সুবিধা নিয়ে কিংবা দায়িত্ব এড়িয়ে তারা বিষয়টি দেখেও দেখেন না। কিন্তু কেন? যদি তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে বিষয়গুলো কঠোরভাবে নজরদারি করতেন তাহলে হয়ত দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির সংখ্যা কিছুটা কমতো। আর নিম্নআয়ের পরিবারগুলো তাদের উপার্জনক্ষম একমাত্র প্রিয়জনকে হারাতো না। আর হারালেও অন্তত জানতে পারতেন।

Comments

The Daily Star  | English
Increased power tariffs to be effective from February, not March: Nasrul

Improving summer power supply: Govt pays half the subsidy power ministry needs

The Finance Division last week disbursed Tk 1,500 crore in subsidy against the power ministry’s demand for the immediate release of Tk 3,000 crore to boost electricity supply during the summer months.

10h ago