তৃতীয় ঢেউয়ে দেশে এতো প্রাণহানি কেন

বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যে প্রায় একই সঙ্গে কোভিড মহামারির তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। দুদেশেই সংক্রমণ হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। যুক্তরাজ্যের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয় ২৫ মে এবং বাংলাদেশে ১ জুন। দুদেশেই করোনা সংক্রমণের হার প্রায় একই রকম। যুক্তরাজ্যে বর্তমানে করোনাভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট এক দশমিক ৪৩ এবং বাংলাদেশে তা এক দশমিক ৪২। রিপ্রোডাকশন রেট এক এর কম হলে বোঝা যায় সংক্রমণ কমছে, আর এক এর বেশি হলে সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের গতি এই দুদেশে এক রকম হলেও মৃত্যু সংখ্যায় রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে একটা আইসিইউ বেডের জন্য ৫৪ জন অপেক্ষায় আছেন। ১০ জুলাই ২০২১। ছবি: টিটু দাস/স্টার

বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যে প্রায় একই সঙ্গে কোভিড মহামারির তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। দুদেশেই সংক্রমণ হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। যুক্তরাজ্যের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয় ২৫ মে এবং বাংলাদেশে ১ জুন। দুদেশেই করোনা সংক্রমণের হার প্রায় একই রকম। যুক্তরাজ্যে বর্তমানে করোনাভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট এক দশমিক ৪৩ এবং বাংলাদেশে তা এক দশমিক ৪২। রিপ্রোডাকশন রেট এক এর কম হলে বোঝা যায় সংক্রমণ কমছে, আর এক এর বেশি হলে সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের গতি এই দুদেশে এক রকম হলেও মৃত্যু সংখ্যায় রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত।

যুক্তরাজ্যে তৃতীয় ঢেউয়ের শুরু থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন প্রায় পাঁচ লাখ ৬০ হাজার মানুষ, যার ভেতরে মারা গেছেন ৫৯৭ জন। সেই হিসেবে তৃতীয় ঢেউয়ে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুহার মাত্র শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের তৃতীয় ঢেউয়ে ১ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৮৭ হাজার মানুষ এবং মারা গেছে তিন হাজার ১৩২ জন। এক্ষেত্রে মৃত্যুহার এক দশমিক সাত শতাংশ। অতএব, তৃতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশের মৃত্যুহার যুক্তরাজ্যের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি।

গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ এ গড় মৃত্যুহার ছিল তিন শতাংশ। এরপর গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশটিতে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ৬৭ শতাংশ মানুষকে টিকার একটি ডোজ এবং ৫০ শতাংশ মানুষকে দুটি পূর্ণ ডোজ দেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক সেরোসার্ভাইল্যান্স সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৮৫ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিপরীতে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে করোনা সংক্রমণ ও টিকার মাধ্যমে। সেদিক দিয়ে বলা যায়, যুক্তরাজ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। আর এর ফলে তৃতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুহার তিন শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশে নেমেছে। বাস্তবিক পক্ষে দেশটিতে সফল গণটিকা কার্যক্রম মৃত্যু কমিয়ে ফেলেছে ৩০ গুণ। এ কারণেই দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ সংক্রমিত হওয়ার পরও প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে মাত্র ১৪ জন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। কঠোর লকডাউন দেওয়া হলেও মানুষ যথাযথভাবে তা মানছে না। দেশে এখন পর্যন্ত টিকার একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন শতাংশ মানুষকে এবং দুটি পূর্ণ ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র দুই দশমিক সাত শতাংশকে। এখন পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে এক কোটির কিছু বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশে এখন মজুদ আছে প্রায় ৫৬ লাখ ডোজ টিকা, যা দিয়ে আরও ২৮ লাখ মানুষকে টিকার দুটি পূর্ণ ডোজ দেওয়া যাবে।

দেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে আরও ১০ কোটি মানুষের জন্য ২০ কোটি ডোজ টিকা দরকার। গত চার মাসে দেশজুড়ে টিকা দেওয়া হয়েছে মাত্র এক কোটি ডোজ। এই গতিতে টিকাদান কর্মসূচি চললে ২০ কোটি ডোজ টিকা দিতে সময় লাগবে সাড়ে ছয় বছর। অতএব স্বাভাবিক ভাবেই দৈনিক টিকা দেওয়ার গতি বাড়াতে হবে বহুগুণ। দৈনিক যদি পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া যায় তাহলে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সময় লাগবে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে আট গুণ বড় হলেও এরই ভেতর দেশটিতে টিকার অন্তত একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে ২২ শতাংশ মানুষকে এবং দুটি পূর্ণ ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশকে। বাংলাদেশ যেখানে প্রতিদিন টিকা দিচ্ছে কয়েক হাজার ডোজ, সেখানে ভারত প্রতিদিন দিচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ ডোজ। এ পর্যন্ত ভারতে ৩৭ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স (AIIMS) ভারতে একটি সেরোসার্ভাইল্যান্স চালায়, যাতে দেখা যায় দেশে গড়ে ৬৭ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই অ্যান্টিবডির পরিমাণ শহরাঞ্চলে ৭৯ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৬৩ শতাংশ। একই সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, যারা টিকা নিয়েছে তাদের ভেতর কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কমে যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। এই ফলাফলটি সাম্প্রতিক পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের একটি সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গেও মিলে যায়। সুতরাং বলা যায়, ভারতের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের শরীরে এখন করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

আগামী দু-তিন মাসের ভেতরে ভারতে আরেকটি ঢেউ আসতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে সেই ঢেউয়ে সংক্রমণ হলেও মৃত্যু হয়তো অপেক্ষাকৃত অনেক কম হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বড় পরিসরে দেশব্যাপী কোনো সেরোসার্ভে চালানো হয়নি। আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর’বির পক্ষ থেকে যে দুটো সেরোসার্ভে চালানো হয়েছে তা শুধুমাত্র ঢাকা শহর এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি এলাকার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডির তথ্য দেয়। কোনোভাবেই তা গোটা দেশের সেরোপ্রিভ্যালেন্সের চিত্র তুলে ধরে না।

মহামারির এই ১৬ মাসেও আমরা জানতে পারলাম না দেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চলে কোভিডের সেরোপ্রিভ্যালেন্স কোন অবস্থায় রয়েছে। তবে, সেরোসার্ভাইল্যান্সের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছিল মহামারির একদম শুরুতেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনাভাইরাসের একটি অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। দেশে উদ্ভাবিত এই কিট সময়মতো বাজারে আনতে পারলে আজ স্বল্প খরচেই দেশে সেরোসার্ভে চালিয়ে দেশের মানুষের ইমিউন স্ট্যাটাস বা সেরোপ্রিভ্যালেন্স জানা যেত।

উপরের তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে, টিকা কোভিড থেকে জীবন বাঁচায়। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী টিকা ইংল্যান্ডের তৃতীয় ঢেউয়ে এ পর্যন্ত ২৭ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। বাংলাদেশে যদি বিগত চার মাসে বৃদ্ধ এবং ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া যেত, তাহলে এই তৃতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ হলেও মৃত্যু হতো কম।

লকডাউন দিয়ে সাময়িকভাবে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও সামগ্রিকভাবে মৃত্যু কমানো সম্ভব নয়। কেননা, করোনাভাইরাস সহসা পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে না এবং একটি ঢেউয়ের পর আরেকটি ঢেউ আসতেই থাকবে। দেশের মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় না এনে শুধু লকডাউনের ওপর নির্ভর করলে, সারা বছরই লকডাউন দিয়ে বসে থাকতে হবে। এতে জনজীবন অচল হয়ে পড়বে, ভেঙে পড়বে অর্থনীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা।

যখন কোভিডের টিকা ছিল না তখন হয়তো মহামারি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। তবে এখন একাধিক কোম্পানি টিকা তৈরি করছে। পাঁচটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনও পেয়েছে। বাংলাদেশের উচিত অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহের মাধ্যমে গণটিকার গতি ত্বরান্বিত করা। বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রম চলছে শম্বুক-গতিতে। এর পেছনে যে শুধু টিকা সরবরাহের ঘাটতি, তা নয়। হাতে যা টিকার মজুদ রয়েছে তাও দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। বাংলাদেশে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও কোনো এক বিশেষ কারণে তা হচ্ছে না। ধীর গতিতে টিকা দিলে মহামারি নিয়ন্ত্রণে এর সক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়। ভারত প্রতিদিন ৩০ লাখ ডোজ দিতে পারলে বাংলাদেশ কেন প্রতিদিন পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দিতে পারবে না? আগামী দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে কি ২৮ লাখ মানুষকে এক ডোজ করে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না? টিকার একটি ডোজও কোভিড থেকে জীবন রক্ষা করে।

বাংলাদেশে তৃতীয় ঢেউয়ে অধিক মৃত্যুর আরেকটি কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার অভাব। গত দুটো ঢেউ ছিল মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু এবারের ঢেউয়ের শুরু এবং বিস্তার ঢাকার বাইরের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে, যেখানে কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন সরবরাহ এবং আইসিইউর অভাব প্রকট। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। তখনই যদি দ্রুততার সঙ্গে এসব অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর কোভিড ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতা বাড়ানো হতো তাহলে আজ এতো মৃত্যু দেখতে হতো না।

এবারের লকডাউনে হয়তো সংক্রমণ কমে যাবে, মৃত্যুও হয়তো কমবে। তবে দুমাসের ভেতরেই শুরু হবে আরেকটি ঢেউ। আসন্ন চতুর্থ ঢেউয়ে মৃত্যু কমাতে হলে সরকারকে এখনই তিনটি ব্যবস্থা নিতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। সেগুলো হলো-

১. গণটিকা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা এবং দৈনিক কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে দিতে হবে ষাটোর্ধ্ব এবং উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা সকল মানুষকে। কোভিডে তারাই মারা যাচ্ছেন বেশি।

২. ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সব জেলায় হাসপাতালগুলোতে কোভিড চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে দুই থেকে তিনগুণ।

৩. সারা দেশে পদ্ধতিগতভাবে সেরোসার্ভাইল্যান্স চালাতে হবে, যাতে করে দেশে আপামর জনগণের ইমিউন স্ট্যাটাস জানা যায়। এই তথ্য ছাড়া গণটিকা কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

 

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

11 years on, cries for justice remain unheeded

Marking the 11th anniversary of the Rana Plaza collapse, Bangladesh's deadliest industrial disaster, survivors and relatives of the victims today gathered at the site in Savar demanding adequate compensation and maximum punishment for the culprits

58m ago