ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ক্রসফায়ার
বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বহুল আলোচিত পুরনো বিষয়। সম্প্রতি র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে এটা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে ক্রসফায়ার অনেকটা ওপেন-সিক্রেট হলেও এ নিয়ে বহুমাত্রিক মতবাদ চালু আছে। অনেকে মনে করেন, অপরাধ দমনে ক্রসফায়ার একটা বিকল্প ও কার্যকারী মাধ্যম যা পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার এক গোপন অস্ত্র। তবে এমন চিন্তার আধিক্য শাসক দলগুলোর মধ্যেই বেশি থাকে। তবে, আন্তর্জাতিক সংগঠন, এনজিও, সিভিল সোসাইটি আর চিন্তাশীল নাগরিকেরা ক্রসফায়ারকে স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন মনে করেন। অন্যদিকে, অনেকে একে নির্বাহী শাস্তির পদ্ধতিও মনে করেন।
পক্ষে বা বিপক্ষে মতবাদ যাই থাক না কেন, এটা অপরাধ দমনের এক সহজ, নির্দয় আর শর্টকাট পদ্ধতি মাত্র। ন্যায় বিচারের পরিবর্তে এখানে নির্বাহী আদেশে বিচার নিশ্চিত করা হয়। কয়েকটি অবিশ্বাসযোগ্য গল্প দিনের পর দিন প্রচার করা হয় ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা আর অবস্থার প্রেক্ষিত হিসেবে। শাসক গোষ্ঠী আর নির্বাহী বিভাগ ছাড়াও এ দেশের অনেক মানুষই ক্রসফায়ারের প্রতি মৌন বা স্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছেন সময়ে সময়ে।
সাধারণ মানুষের এমন সমর্থন আসলেই কি ক্রসফায়ারের প্রতি এক ধরনের মোহ? নাকি অপরাধ দমনের আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি অনাস্থা?
অপরাধ দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা আছে। এর সঙ্গে জড়িত পুলিশ, প্রসিকিউসন এবং বিচারক। রাষ্ট্রের এই ৩ শ্রেণির পেশাজীবীদের সম্মিলিত ও দায়িত্বশীল চেষ্টার মাধ্যমে একটা বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে অপরাধীর সাজা হয় এবং অপরাধ দমন হয়। কিন্তু, এই ৩ শ্রেণির মধ্যে যদি কখনো দায়িত্বের ঘাটতি, অবহেলা বা সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়, তাহলে ন্যায় বিচার সেখানে বিলম্বিত অথবা বিঘ্নিত হতে বাধ্য। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, এ দেশে অপরাধের বিচারের আইনি ব্যবস্থা বিভিন্ন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত।
দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, পেশাগত দক্ষতা ও সংস্কৃতির অভাব, অপ্রতুল সৎ ও মেধাবী আইন রক্ষাকারী পেশাজীবী, সরকারি আইনজীবী ও বিচারকের অভাব, ভুয়া সাক্ষী অথবা সঠিক সাক্ষীর অভাব দীর্ঘদিন ধরে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ত্রুটিযুক্ত ফৌজদারির বিচার ব্যবস্থার এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক দায়মুক্তি, সরকারের অপরাধ দমনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং অপরাধ সিন্ডিকেটের তুমুল প্রভাব ছিন্ন করার নিমিত্তে এক শর্টকাট ও সস্তা পদ্ধতি আজকের ক্রসফায়ার।
তবে ক্রসফায়ার এ দেশে খানিকটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই সময়ে যখন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের নামে যখন বিভিন্ন বাহিনী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এদের নির্মূল করার লক্ষ্যে মূলত ক্রসফায়ার সংস্কৃতির আবির্ভাব। কিন্তু পরবর্তীতে এর বিচ্ছিন্ন ব্যবহার, এই পদ্ধতির আইনি ও নৈতিক ব্যুৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিচার বহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ারের নামে অপরাধ দমন কখনো একটা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে না। বরং এমন পদ্ধতি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং কালক্রমে তাই হয়েছে। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে অপরাধীর নামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছে। নিরপরাধ বা তুলনামূলক কম অপরাধীরাও ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে লঘু পাপে গুরুদণ্ড ভোগ করেছেন। অথচ অনেক বড় অপরাধী থেকে গেছে নিরাপদে।
মূলত মূলধারার অপরাধীদের বিনাশ করতে ক্রসফায়ারের আবির্ভাব হলেও হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল, যেমন পেশাজীবী দুর্নীতিবাজ, অপরাধের হুকুমদাতা, আর্থিক অপরাধী, বড় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অপরাধী বা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অপরাধ ঘটায় এমন ক্ষমতাবান অপরাধীদের ক্ষেত্রে ক্রসফায়ার প্রয়োগ করতে তেমন একটা দেখা যায়নি। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে, ক্রসফায়ার কি অপরাধ আর অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের শ্রেণিবিভাগ তৈরি করেছে? যেখানে অপরাধীদের মধ্যেও ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের এক অপ্রকাশ্য মেরুকরণ করা আছে।
ক্রসফায়ারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে একজন 'অদৃশ্য' ঊর্ধ্বতন ক্ষমতাবানের আদেশ বলে কার্য সম্পাদন করা। এখানে ব্যক্তির আক্রোশ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, তথ্যের ঘাটতি অথবা ভুল তথ্যের ওপর নির্ভরতা একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। অপরাধ প্রমাণের আগেই সাজা নিশ্চিত হয়ে যায়। অপরাধীর আপিলেরও কোনো সুযোগ থাকে না। সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রচলিত বিচার বিভাগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়।
পুলিশ হেফাজতে এই ধরনের ক্রসফায়ারে মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার পরও যখন এর বিরুদ্ধে কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয় না, অথবা সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিচারের সম্মুখীন করা হয় না, তখন প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্র কি নিজেই এমন হত্যার লাইসেন্স দেয়? রাষ্ট্র কি নিজেই এমন হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয়? এমনটা করতে গিয়ে রাষ্ট্র কি নিজেই অপরাধী হয়ে পড়ে না?
ক্রসফায়ারের মাধ্যমে আসলে অপরাধ দমন হয় না, বরং একজন অপ্রমাণিত অপরাধীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় মাত্র। অথচ যে সব দেশে আইনের শাসন জোরালো, সেখানে ক্রসফায়ার লাগে না। সঠিক ও সময়মত ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা মানুষকে এমনিতেই অপরাধ বিমুখ করে তোলে। দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা যদি তাদের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধকে অলাভজনক বা অপরাধের পরিণতিকে সাংঘাতিক পীড়াদায়কে পরিণত না করতে পারে, তবে অপরাধ কখনো কমবে না। আর এর জন্য দরকার, দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বিভাগ, যথেষ্ট দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রপক্ষীয় কৌসুলি ও বিচারক, আর সর্বোপরি সরকারের সদিচ্ছা।
ক্রসফায়ার একটা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু থাকলে রাষ্ট্র কখনোই তার আইনি আর বিচারিক ব্যবস্থার সমস্যাগুলো সমাধান করতে সচেষ্ট হবে না এবং যেকোনো সরকারই তার সুযোগ নিবে।
মো. রবিউল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments