বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংকট ও সাফারি পার্কের বিলাসিতা

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে আমাদের পাড়ার নাম বাঘখাইয়ার বাড়ি (যে বাড়িতে বাঘের আনাগোনা ছিল নিয়মিত ঘটনা)। বাড়ির বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে শুনেছি যে প্রায় শত বছর আগে বাঘের মুখ থেকে স্বজনকে রক্ষা করতে গিয়ে একটি বাঘ মারা পড়লে প্রতিবেশীরা এ নামেই নামকরণ করেছিল আমাদের পাড়ার নাম। এখন আমাদের পাড়া থেকে দক্ষিণে দুই-তিন মাইলের অদূরে থাকা বনে কিছু হাতির দেখা মিললেও হারিয়ে গেছে বাঘসহ অসংখ্য প্রাণী। বাংলাদেশের ১৩ জেলায় একসময় বাঘ ও হাতির অস্তিত্ব ছিল। এখন সুন্দরবন ছাড়া কেথাও বাঘের দেখা মেলে না। হাতির অস্তিত্ব এখন আবদ্ধ হয়ে আছে পার্বত্য অঞ্চল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে।
এ বদ্বীপে থেকে একে একে হারিয়ে গেছে নীলগাই, বনগরু, চিতা, সুমাত্রা গন্ডার, জাভা গন্ডারও ভারতীয় গন্ডার। ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার আইইউসিএনের তথ্যমতে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে হায়েনা, গন্ডারসহ ৩১টি বন্যপ্রাণী।
দিন যতই যাচ্ছে দেশের বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংকট বাড়ছে। তাদের আবাসস্থলজুড়ে অব্যাহত থাকা দখল-বেদখল ও নানা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে বনাঞ্চল। বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়ার নিশ্চিত পরিণাম হিসেবে কমে আসবে বন্যপ্রাণীও। বনাঞ্চল ছাড়া বন্যপ্রাণী গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষের মতো। মানুষের তো অন্তত যাওয়ার জায়গা থাকে। বন্যপ্রাণীদের পরিণতি হয় অনাহারে, অর্ধাহারে ধীরে ধীরে মৃত্যু আর লোকালয়ে এসে পড়লে মানুষের হাতে প্রাণ হারানো।
এই যখন দেশের বন্যপ্রাণীর অবস্থা তখন আমরা দেখছি বিদেশ থেকে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী এনে দেশে সাফারি পার্ক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ যেন নিজের ঘরের সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে সে শুন্যতা বিদেশি প্রাণী দিয়ে পূরণ করা। সাথে আছে আর্থিক লাভের হিসেব। আমাদের জাতীয় জীবনের অপরিহার্য বিষয়গুলো কখনো এ আর্থিক লাভের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ফলে, দেশের ক্ষতি বেড়ে চললেও, লাভ হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের।
হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারের লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক করার প্রস্তুতি চললেও, বাঘ সংরক্ষণে মাত্র ৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ফিরিয়ে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এ প্রকল্প থেকে কোনো আয় বাড়বে না। যা কিছু আমাদের নগদ লাভ দেয় সেটার বাইরে গিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ, বনাঞ্চলের নিজস্ব বাস্তুসংস্থানের গুরুত্ব বুঝতে না পারার অক্ষমতা আমাদের মানসিক দৈন্যের প্রকাশ। এ মানসিক দৈন্যের পরিবেশগত প্রভাব সামনের দিনে আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
সাফারি পার্কের নামে বিদেশি নানা প্রজাতির প্রাণী এনে আমাদের বনাঞ্চলে ছাড়া হবে। এগুলো প্রদর্শন করা হবে, ফলে হাজার হাজার পর্যটক এসে বন্যপ্রাণীদের ব্যাঘাত ঘটাবে। বন আইনে যেখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ সেখানে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হবে পর্যটনের নামে তথাকথিত সাফারি পার্কে। এসব সাফারি পার্ক টেকসই বনব্যবস্থাপনার যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি তার বিপরীত। এতে বনের যে নিজস্ব ইকোলজি সেটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
বন রক্ষা করতে হলে সংরক্ষিত বন থেকে গাছ পাচার বন্ধ করতে হবে, বনের ভেতরে যে চাষাবাদ, মৎস্য খামার, লেবু বাগান, আনারস বাগান, চা বাগান এগুলো বন্ধ করতে হবে। এগুলো করার পেছনে স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজস থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নানা ধরনের বিদেশি প্রজাতির বনায়নের কারণে বন্যপ্রাণীর যে খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে সেটি দূর করতে বনের ভেতরে ফডার ট্রি (বন্যপ্রাণী যে গাছগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করে) সেগুলোর বনায়ন বাড়াতে হবে। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার এটিই পথ।
দেশের এ সমৃদ্ধ বনাঞ্চল ও বৈচিত্র্যময় প্রাণীসম্ভার রক্ষা করতে না পারা এক বিরাট ব্যর্থতা। সাফারি পার্ক করে এ ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না। গত কয়েক দশকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় আইন হয়েছে। আইন প্রয়োগে বন অধিদপ্তর এখনো দৃষ্টান্তমূলক কোনো উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি। একদিকে যেমন তাদের জনবল, যানবাহন, বাসস্থান সংকট অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপ, মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা ও সরকারের জাতীয় অগ্রাধিকারে বন অধিদপ্তর শক্ত ভূমিকা নিতে পারছে না।

Comments

The Daily Star  | English

No scope for police to verify authenticity of cases: IGP

Instructions have already been issued to ensure that no one is arrested in a harassing manner, he says

6m ago