বুয়েট ছাত্রের যৌন হয়রানির ঘটনা আচানক নয়

বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) ১৯ ব্যাচের এক ছাত্র দীর্ঘদিন ধরে মেসেঞ্জারে উত্ত্যক্ত করেছে তারই সহপাঠী এক মেয়েকে। সে আপত্তিকর কথাবার্তা, ইমোজি, ছবি ও ভিডিও পাঠিয়েছে। এই যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মেয়েটি এক সময় মুখ খোলে। ধরা পড়ার পরও তারা একে শুধুমাত্র কৌতুক বা ফাজলামি বলছে।
প্রতীকী ছবি। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) ১৯ ব্যাচের এক ছাত্র দীর্ঘদিন ধরে মেসেঞ্জারে উত্ত্যক্ত করেছে তারই সহপাঠী এক মেয়েকে। সে আপত্তিকর কথাবার্তা, ইমোজি, ছবি ও ভিডিও পাঠিয়েছে। এই যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মেয়েটি এক সময় মুখ খোলে। ধরা পড়ার পরও তারা একে শুধুমাত্র কৌতুক বা ফাজলামি বলছে।

ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় ওই ছেলের সঙ্গে তার তিন বন্ধুও জড়িত। তারা ছেলেটির এই অপকর্মে বাধা তো দেয়ইনি বরং আরও উৎসাহ যুগিয়েছে এই যৌন নিপীড়ন চালাতে। দলগতভাবে এই যৌন প্রস্তাব পুরো কমিউনিটিকে অপমানিত করেছে বলে বুয়েটের সিএসই ১৯ ব্যাচ ও তাদের ডিপার্টমেন্ট ওই চার ছেলেকে বয়কট করেছে।

এ ঘটনা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটলে ঠিক এতটাই শোরগোল হতো কিনা জানি না। কিন্তু, এক্ষেত্রে হয়েছে। কারণ, ঘটনাটা ভয়াবহ এবং এটি ঘটিয়েছে বুয়েটের ছেলেরা।

আমরা মনে করি, বুয়েট মানেই সব কিছুতে সেরা। পাত্র হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার সবচেয়ে লোভনীয়। এ রকম ধারণা থেকেই ছেলেগুলোর মনে হয়েছে, কোনো মেয়ে হয়তো বুয়েটের ছাত্রকে 'না' করবে না, সাড়া দেবেই। আর যখন তা হয়নি, তখনই বুয়েটের ভালো ছাত্র, স্মার্ট ছেলে, ভবিষ্যতের ভালো পাত্র ইত্যাদি সব মুখোশ খুলে পড়েছে।

শুধু তো বুয়েট নয়, এই চার শিক্ষার্থীর মধ্যে তিন জন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করেছে নটরডেম কলেজে এবং একজন পড়েছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সানিডেলে। এ ধরনের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ছেলেদের নৈতিক অবস্থা নিয়েও কথা বলছেন অনেকে।

অভিযুক্ত ছেলেটি মেয়েটিকে পছন্দ করতো। যেকোনো মেয়েকে যেকোনো ছেলের ভালো লাগতেই পারে এবং সেই কারণে সে মেয়েটিকে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ জানাতেই পারে। কিন্তু, মেয়েটি রাজি হলো না বলে তাকে যৌন হয়রানি করাটা হয়ে যায় অপরাধ।

কোনো ছেলের যদি কোনো মেয়েকে দেখে বা তার ছবি দেখে মনে যৌন ইচ্ছা জাগে তাহলে বুঝতে হবে সেটা প্রেম বা বন্ধুত্ব নয়, সেটা শুধুই নিজের কামনা মেটানোর ইচ্ছা।

কোনো মেয়েকে যৌন নির্যাতন করে যারা আনন্দ পায়, তাদের সেই অবস্থাকে প্রেম বলা যায় না এবং তারা মানসিকভাবে স্বাভাবিকও নয়। কারণ, প্রেম হচ্ছে একে অন্যকে সম্মান করা ও নিজের সম্মানও বজায় রাখা।

এ ঘটনায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এ রকম 'ভালো ছাত্র'রাও কেন একজন নারী সহপাঠীকে যৌন বস্তু মনে করে? এটা এক ধরনের মনোবিকার। এর সঙ্গে ভালো বা খারাপ ছাত্র, বুয়েট বা কলেজ, ধনী বা দরিদ্র, এমনকি সামাজিক পরিচিতির তেমন কোনো সম্পর্ক নাই।

আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের কাছে নির্যাতনের একটা উপায়। এদের মতোই বিকৃত রুচির মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তায়, পাড়ায়-মহল্লায় কাপড় তুলে মেয়েদের দেখাতো। এরাই মেয়েদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাজে মন্তব্য করে, ফোন করে অশ্লীল কথা বলে, বাসে নারী সহযাত্রীর গায়ে হাত দেয়।

সেই আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছোট ছোট সিঁড়িগুলো দিয়ে মেয়েরা একা আসা-যাওয়া করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না। কারণ, সেখানে কোনো কোনো ছাত্র প্যান্টের জিপার খুলে দাঁড়িয়ে থাকতো। যেকোনো মেয়েকে বিব্রত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

মেয়েদের মধ্যেও অনেকে ছেলেদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। শুধু যে ছেলেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজে ছবি ও বার্তা শেয়ার করে, তা নয়। মেয়েরাও অযাচিত আচরণ করে। তবে তা সংখ্যায় অতি নগণ্য। কারণ, মেয়েদের নানারকম সামাজিক বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

মেয়েদের এই মানসিকতার জন্য সামাজিক কিছু ধারণা কাজ করে। সমাজে ছোটবেলা থেকেই অধিকাংশ পরিবার থেকে মেয়েদের ধারণা দেওয়া হয় যে 'আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারি'।

মেয়েদের বোঝানো হয়, তার চেহারা, সৌন্দর্য ও আকর্ষণী ক্ষমতাই সেরা। মেয়েরা এই ক্ষমতা ছোটবেলা থেকেই অনুভব করতে থাকে।

নারী বা পুরুষের যৌনতা অপরাধ নয়। পরিণত মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও নিরাপত্তার চাহিদার পরেই প্রয়োজন যৌন ক্ষুধা মেটানো। তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে নির্যাতন, লুকোচুরি, চাতুরী, শঠতা ছাড়া। অশ্লীল ও নোংরা আচরণ যৌনতার উপজীব্য হতে পারে না।

যৌন নিপীড়ন যারা করে তারা প্রথমে ছোট ছোট নিপীড়ন করে। এগুলো মানুষের দেখার চোখকে নষ্ট করে দেয়। সে সুন্দর-অসুন্দরের ফারাক বোঝে না। সে তার চিন্তা, আচরণ এবং নিজের ও অন্যের আনন্দময় জীবনকে কলুষিত করে।

এটা সত্যি যে বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই দৈহিক হরমোনের কারণে ছেলে ও মেয়েদের যৌন আকাঙ্খা তৈরি হয়। আর এখানেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি তৈরি হয়। এটি দমনে সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী একেক মানুষ একেক কৌশল গ্রহণ করে থাকেন।

তখনই আসে ব্যক্তির সামাজিক পরিস্থিতি, বন্ধুবান্ধব, পরিবেশ, শিক্ষা, পরিবার, প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু। যারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং এগুলো থেকে নেতিবাচক দিকটি গ্রহণ করে, তারাই ক্রমশ এমন বিকৃত মানসিকতার হয়ে উঠে। মানসিক বিকারগ্রস্ত বা বিচ্ছিন্ন মানসিকতার যারা, তারাই সাধারণত অপরিচিত মেয়ে, সহকর্মী অথবা সহপাঠীদের প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ উস্কানিমূলক আচরণ করে থাকে।

যে সব ছেলে আবেগগতভাবে বুদ্ধিমান তারা দ্রুতই বুঝে ফেলে কোনটা বন্ধুত্ব, কোনটা প্রেমের আকর্ষণ আর কোনটাতে সে যৌনতাকে পুঁজি করছে। এই মূল্যবোধ যাদের থাকে তারা নিজেদের সেক্স লাইফকে ইতিবাচক, আনন্দদায়ক ও জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভাবে এবং সেসব বিষয়ে সচেতন থাকে। এর অর্থ সব সময়, সব জায়গায় যৌনবিষয়ক চিন্তা নয়। বরং বয়স, পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলা। সে তার পরিবার, বন্ধু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সহপাঠী ও অচেনা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে এসব বিষয়ে সচেতন ও দায়িত্ববান থাকে।

আবেগগতভাবে নির্বোধ, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও গোঁয়ার শ্রেণির মানুষ এই প্রভেদ বুঝতে পারেন না। ফলে, তারা যৌন নিপীড়ন চালিয়ে যায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য।

এ ধরনের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে চলছে আমাদের দেশের অনেক মানুষ। যারা সচেতন মনেই নারীকে শুধু যৌন বস্তু মনে করে। যেহেতু তারা যৌনতাকে মন্দ ও ঘৃণার বিষয় মনে করে, তাই তা নিয়ে কোনো সচেতন চিন্তা-ভাবনা, আলাপ বা শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা নারীকে যে কোনোভাবে যৌনতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যেমনটা করেছে বুয়েটের ছেলেটি ও তার বন্ধুরা।

বুয়েটের ছেলের এই ঘটনা একক কোনো ঘটনা নয়। কারণ সামগ্রিকভাবে টিনএজ ও তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের মানসিকতা এমনই। অবদমিত যৌন আচরণ থেকে তারা এই জাতীয় কাজ করে কখনো অনলাইনে, কখনো সামনাসামনি, কখনো চিঠি বা ছবি পাঠিয়ে। এর দায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, প্রযুক্তি মাধ্যম বা নির্দিষ্ট কমিউনিটির নয়।

নৈতিক অবক্ষয় যখন সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবদিক থেকে একে রহিত করার উদ্যোগ নিতে হয়। কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়, বিদ্যালয়গুলোতে নীতি-নৈতিকতা, জীবনবোধ, প্রজনন স্বাস্থ্য, সঠিক যৌনশিক্ষা ও সুস্থ বিনোদন বিষয়ে জানাতে হবে।

পরিবার ও সমাজকে যৌনতার ট্যাবু ভেঙে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে, সন্তানকে সময় দিতে হবে। নারী-পুরুষের পারস্পারিক সম্পর্ককে সম্মান দিতে হবে। এ ব্যাপারে সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। শুধু শাস্তি দিয়ে বা সামাজিকভাবে বয়কট করে এই মানসিকতার মানুষদের সুপথে আনা সম্ভব নয়।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Has the war in Gaza exposed limitations of free speech in US?

Protests have rocked US university campuses over the last week as pro-Palestinian students have encamped on the grounds of Columbia, Yale, and New York University, among other prestigious educational institutions, urging universities to divest from the state of Israel amid the ongoing genocide.

7m ago