বেকার সমস্যা ও সংসদ সদস্যের বিবাহতত্ত্ব

দেশে বেকার সমস্যা সমাধানকল্পে চাকরিজীবী নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে বন্ধে আইন চেয়েছেন বগুড়া থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য। বগুড়া-৭ আসন থেকে নির্বাচিত এই সাংসদ গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে 'জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিল-২০২১' এর ওপর আলোচনা করতে গিয়ে এই দাবি উত্থাপন করেন।
পত্রিকার খবর মতে, সংসদ সদস্য এই অভিনব দাবিটি উত্থাপনকালে সংসদে হাসির রোল পড়ে যায়। সংসদের বাইরেও বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে হাস্যরসের বান বয়ে চলেছে। কিন্তু তত্ত্বটা যতই হাস্যরসাত্মক হোক না কেনো, এতে যে মৌলিকত্ব আছে— তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এর আগে কোনো চিন্তাবিদই এমন করে বেকার সমস্যা নিয়ে ভাবেননি। অবশ্য বাঙালি বরাবরই অভিনবত্বের অনুসন্ধানী। এর অনেক প্রমাণ আছে নিকট অতীতেই। আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কেউ একজন নাকি 'ড্রাম তত্ত্ব; হাজির করে বলেছিলেন, জনৈক রাজনীতিবিদ একটা ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা 'ধাক্কা তত্ত্বের' কথাও শুনেছি; বিরোধী দলের ধাক্কায় নাকি কারখানা ভবন ধসে পড়েছিল। আর 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে' এই তত্ত্বও সুবিদিত। তবে বেকারত্ব দূরীকরণে বিয়ে-তত্ত্ব নিয়ে কেউ আগে হাজির হননি। তাই এর মৌলিকত্ব অতি অবশ্যই গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। সে জন্যই তত্ত্ব উত্থাপনকারীকে নিয়ে হাসির কিছু দেখছি না। তা ছাড়া, তাকে তো আমরাই ওখানে পাঠিয়েছি। হয়তো ভবিষ্যতেও পাঠাব। কারণ আমরাতো এমন লোকই চাই! তাই তার মেধা-মনন নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কোনো অবকাশ নেই।
যারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা কি ভুলে গেছেন কেমন করে 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী'রা নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাকশো ভরে রেখেছিলেন? তখন তো কেউ প্রতিবাদ করেননি? তাহলে এখন কেন? এ কথাতো আমাদের দেশে সুবিদিত যে কালো টাকা, কিছু হোন্ডা-গুন্ডা আর সেই সঙ্গে যদি একটা যুৎসই মার্কা থাকে তাহলে সংসদ সদস্য হওয়া এমন কিছু নয়। তাই আজ সাংসদের মেধার খোঁজ নেওয়া একটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। লাগাবো তেঁতুল গাছ, আর আশা করবো আম— এটা কি কখনো হয়? তবে অন্তত একটা বিষয়ে এই জনপ্রতিনিধিকে অভিনন্দন জানাতেই হয়, তিনি অন্তত বুঝেছেন সংসদ হলো আইন প্রণয়নের জায়গা। যে সত্যটা অধিকাংশ সংসদ সদস্যই জানেন না বা মানেন না। তাইতো সংসদে তারা কখনো আইন নিয়ে কথা বলেন না। হাতে গোনা দু-চার জন ছাড়া আর কাউকে কখনো কথা বলতে শোনাও যায় না।
এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে; এক. তারা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন; তাই কী বলতে কী বলে ফেলেন এ নিয়ে সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকেন। দুই. সংসদে কথা বলার জন্য যে মেধা এবং বাচনিক যোগ্যতা থাকা দরকার সেটি তাদের নেই। এ কারণে তারা ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টদের মতো 'সহমত ভাই'-এর ভূমিকা পালন করেন।
এ কথাতো সবাই জানেন, এই যে দেশে এত কিছু ঘটছে। হু হু করে বাড়ছে সিলিন্ডার গ্যাসের (এলপিজি) দাম, দুর্নীতির বোঝা বইতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছে স্বাস্থ্য খাত, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, এসব নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা নেই। এসবের বাইরেও গত তিন বছরে অনেক দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বেশ কিছু চুক্তি করেছে বলে শোনা যায়। কোনো চুক্তির আগেই সংসদে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে শোনা যায় না। আমাদের সংসদ সদস্য মহোদয়েরা ব্যস্ত তাদের প্রাধিকার নিয়ে। সেইসঙ্গে তাদের ঐচ্ছিক তহবিলের বরাদ্দ বণ্টনে। এর বাইরে কখনো তাদের কথা বলতে শোনা যায় না। আবার কেউ কেউ তো আছেন কোনো প্রসঙ্গেই কিছু বলেন না। যখন আমি আফগানিস্তানে ছিলাম তখন দেখেছি, সেখানেও সাংবিধানিক কোনো পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতো। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সংসদে তলব করে তার যোগ্যতা যাচাই করা হতো। কিন্তু আমাদের দেশে যখন যাকে খুশি যে কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
সংসদ কিংবা সংসদ সদস্য কেউই অবগত নন। কেউ কিছু বলতেও পারেন না। আমাদের মতো আমজনতার মতোই খবরের কাগজ পড়ে তারা সেসব খবর জানতে পারেন। নামে সংসদীয় গণতন্ত্র হলেও কার্যত সংসদ 'সহমত ভাইদের' আড্ডাখানা ছাড়া আর কিছু হয়ে ওঠেনি আজও।
আসলে দেশ নিয়ে ভাবনার সময় কোথায় আমাদের মাননীয় সংসদদের? নির্বাচনি এলাকায় এত এত ফিতা কাটতে হয় যে অন্য কিছু ভাবার সময়ই বা কোথায়? এই যে ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেছে সেই ২০১৬ সালে। অথচ ঠিকাদারের ব্যর্থতায় সঞ্চালন লাইন তৈরি না হওয়ায় এটি পুরো সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। এ জন্য সরকারকে চুক্তি মোতাবেক ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে মাসে ১০০ কোটি টাকা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। এ জন্য সরকারকে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কেউ কি এসব নিয়ে কথা বলেছেন? সংসদে কি এ নিয়ে কখনো কোনো আলোচনা হয়েছে? হবে কেমন করে? উনারা সবাই ব্যস্ত মানুষ।
এই ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের বগুড়ার সংসদ সদস্য দেশে বেকারত্ব নিরসন নিয়ে যে চিন্তা করছেন, এ জন্যই তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বলা বাহুল্য, মাননীয় সংসদ সদস্য এই দাবিটি উত্থাপন করেছেন এমন এক সময়ে যখন কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে ভারতে এর হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে বাংলাদেশে মোট কর্মশক্তির অনুপাতে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ।
অবশ্য বিবিএসের জরিপ বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। তবে আইএলওর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, আগামী কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে। যা হবে মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। দেশের এই বাস্তবতায় সংসদ সদস্য যে দেশের বেকারত্ব নিয়ে চিন্তা করছেন তার জন্য তিনি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখেন। আর কেউ তো এইটুকুও ভাবছেন না। তিনি অন্তত এ কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তিনি দেশ নিয়ে ভাবেন।
সে জন্যই তাকে অভিনন্দন। ইতিহাসে নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবেন তিনি 'বিয়ে-তত্ত্বের' উদগাতা হিসেবে।
মোশতাক আহমেদ, সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা
moshtaque@gmail
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments