বৈষম্য যত!

প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

একাত্তর পরবর্তী বীরাঙ্গনা নারীদের পরিচয় নিয়ে যখন সংশয় দেখা দেয় তখন বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন, প্রতিটা বীরাঙ্গনার পিতৃ পরিচয়ের জায়গায় তার নাম লিখে দিতে। আর ঠিকানা যেন দেওয়া হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি। কী মহানুভবতা! কী উদার নৈতিক অবস্থান রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের!

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু স্বাধীন বাংলাদেশকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত আর বিচ্যুত করেছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো রাষ্ট্র তার মানবিকতার বোধ থেকে সরে গেছে। শক্তি, সমতার অভাব আর বৈষম্য মিলেমিশে রাষ্ট্রকে অনেক ক্ষেত্রেই অমানবিক করে তুলেছে।

রাষ্ট্র যদি নির্দয় হয় তবে তার ছাপ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পড়ে। তার বড় প্রমাণ, বাংলাদেশ পুলিশে শুধুমাত্র ভূমিহীন হওয়ার কারণে বরিশালের আসপিয়া ও খুলনার মিমের চাকরি (প্রাথমিকভাবে) না হওয়ার ঘটনা।

যদিও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাদের বাড়ি ও চাকরির বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে জাতীয় দৈনিকগুলোর মাধ্যমে।

কিন্তু, ব্যক্তি উদ্যোগে ওয়ান-বাই-ওয়ান সমাধান কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। এমন বৈষম্যের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আরও দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিদ্ধান্তে মেয়েদের আবাসিক হলে অন্তঃসত্ত্বা ও বিবাহিত ছাত্রীদের থাকতে নিষেধ করাতে। কী অদ্ভুত! রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে দাবি করা প্রতিষ্ঠানে এমন অদ্ভুত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা!

এমন বৈষম্যের আইন বা নীতিমালা বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুচ্ছেদ ৭ (সংবিধানের প্রাধান্য ও প্রজাতন্ত্রের মালিকানা), অনুচ্ছেদ ১০ (সমাজতন্ত্র ও শোষণ মুক্তি), অনুচ্ছেদ ১১ (গণতন্ত্র ও মানবাধিকার), অনুচ্ছেদ ১৫ (মৌলিক প্রয়োজন, অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থাকরণ), অনুচ্ছেদ ২৬ (মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল), অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), অনুচ্ছেদ ২৮ (ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান ভেদে বৈষম্য বাতিল), অনুচ্ছেদ ২৯ (প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সমতা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দান) এবং অনুচ্ছেদ ৪০ (পেশা বা বৃত্তি লাভের অধিকার) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে অসাংবিধানিক হতে বাধ্য।

শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনে এ দেশের মানুষ এমন বৈষম্যের চিত্র দেখে আর সহ্য করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয় এমন বিভাগে বা শ্রেণিতে যার শ্রেণিকক্ষ আছে হয়তো ভবনের ৪ তলায় অথবা ৫ তলায়। আবার সেখানে নেই কোনো লিফটের ব্যবস্থা।

এখনো পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি সেবাদান কেন্দ্রগুলোয় নেই শারীরিক প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রক্ষালনের ব্যবস্থা। রাস্তাঘাটের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ এ দেশের শহরগুলোয় রাস্তাঘাট আর ফুটপাথের যে অবস্থা থাকে সেখানে কেউই ঠিকভাবে চলতে পারে না। তাই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা বলাই বাহুল্য। তারপরও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে নৈতিকতার শিক্ষা আর মানবিকতার আলো ছড়াবে, সেখানে তাদের অবস্থা যেন বিপরীত।

একজন নারী শিক্ষার্থীকে যখন অন্তঃসত্ত্বা বা বিবাহিত হওয়ার কারণে আবাসিক হলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষ আসলে একজন শিক্ষার্থীকে একাধিক বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দেয়। একে বলে বহুমাত্রিক বৈষম্য (intersectionality of discrimination অথবা multiple discriminations)। প্রথম বৈষম্য করা হয় সে নারী বলে আর দ্বিতীয় বৈষম্য করা হয় সে অন্তঃসত্ত্বা বা বিবাহিত বলে।

মাতৃত্ব যেখানে প্রকৃতি প্রদত্ত আশীর্বাদ, সেখানে তাকে বৈষম্যের মাপকাঠি বানানো হচ্ছে। একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থী হয়তো অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছে। সেখানে একটা অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের বলি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার থাকার আশ্রয়টুকু কেড়ে নেওয়া হয়।

আচ্ছা, ওই নারী শিক্ষার্থী কি ভর্তির সময় এমন অদ্ভুত বৈষম্যের বিষয়ে তাদের সম্মতি জানিয়েছিল। নিশ্চয় না। যদি এমন সম্মতি দিয়েও থাকে, তবুও তা সাংবিধানিক আইনের আলোকে বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা।

সম্প্রতি, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ সুনাম কুড়িয়েছে ঘুষ ছাড়া পুলিশে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পেরে। কিন্তু, তাদের এমন ন্যায্য কার্যক্রমের জৌলুস খানিকটা কমে গেছে যখন জানা গেলো চাকরির জন্য স্থায়ী ঠিকানা দরকার।

কষ্ট করে ৭ ধাপের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া ২ নারী চাকরিপ্রার্থী প্রাথমিকভাবে বঞ্চিত হন শুধুমাত্র স্থায়ী ঠিকানার অভাবে। যদিও এমন অনুদার ব্যবস্থা কোনো নির্বাহী সিদ্ধান্ত নয়। বরং বহুদিনের পুলিশের চাকরি আইন সংক্রান্ত নীতিমালা, যা তারা দাপ্তরিক ভেবে মেনে আসছে।

তবে, দীর্ঘদিন ধরে এমন অদ্ভুত আইনি ব্যবস্থা চালু রাখার কারণে রাষ্ট্র ও পুলিশ বিভাগ বৈষম্যের এমন ব্যবস্থার দায় থেকে মুক্ত তা দাবি করতে পারে না। সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রের সংবিধানের বরখেলাপ করতে পারে না।

আসপিয়া ও মিমের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যটা আরও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণটা এ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। এ দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না। অনেক মানুষই কোনোভাবে একটা অস্থায়ী আবাসন নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে। অন্যদিকে, একশ্রেণির অসৎ ও দুর্নীতিবাজ মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুট বা জবরদখল করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের সম্পদ, নামে-বেনামে।

এমন আর্থ-সামাজিক অসমতার দেশে দরিদ্র মানুষের যেখানে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেক বেশি সুযোগ পাওয়ার কথা, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এমন প্রকাশ্য বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা শুধু স্তম্ভিতই করে না, বরং আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটায়।

এ দেশে প্রাথমিকভাবে ২ ধরণের বৈষম্য আছে। একটি প্রকাশ্য আর একটি অপ্রকাশ্য। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে মানুষ কোনো না কোনোভাবে অনেক অপ্রকাশ্য বৈষম্যের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেগুলো করা হচ্ছে হয়তো আইনের মধ্য থেকে, কিন্তু তার পরিণতিও সাংঘাতিক। এমনটার কারণে অনেকেরই ব্যক্তি, শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হচ্ছে নানাভাবে।

এরপরও যদি আবার এমন প্রকাশ্য বৈষম্যের অবতারণা করা হয়, তবে তা বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলাদেশ সূচনার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার অবমাননা ছাড়া আর কিছুই হবে না। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে দরকার মুক্তমনের মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ। যারা কোনো আইন বা নীতিমালা তৈরি করার আগে তার সমতা ও বৈষম্যহীনতার দিকগুলো সূক্ষ্মভাবে বিবেচনায় রাখবেন। কোনো স্থূল নীতিমালার খামখেয়ালিপনা যেন বৈষম্য সৃষ্টি করা আইন বা প্রথা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরি।

মো. রবিউল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Central bank at odds with BPO over Nagad’s future

The discord became apparent after Faiz Ahmed Taiyeb, special assistant to the chief adviser with authority over the Ministry of Posts, Telecommunications and IT, sent a letter to the BB governor on May 12 and posted the letter to his Facebook account recently

1h ago