মহামারিকালে অবহেলিত চা-শ্রমিক
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার রামপুর চা-বাগানের শ্রমিক পবন পাল (৩৮) মারা গেছেন গত ৬ জুলাই। রামপুর বাগানটি ফিনলে চা কোম্পানির মালিকানাধীন রশিদপুর চা-বাগানের একটি ফাঁড়ি বাগান।
গত ২৭ জুন থেকেই পবনের জ্বর ছিল। কিন্তু, ১ জুলাই থেকে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। পরদিন তাকে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তার পারিবার। পবনের পরিবার জানায়, সেখানে চিকিৎসা না পাওয়ায় তারা তাকে হবিগঞ্জ জেলা সদরে নিয়ে যান। হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ তার চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হলে একই দিনে (২ জুলাই) তাকে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি সাধারণ বিভাগে একটি বেড পান এবং ৩ জুলাই তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।
আইসিইউতে তার চিকিৎসা চলে ৬ জুলাই পর্যন্ত। সেদিন তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় এবং বিকেল ৩টা ২২ মিনিটে তিনি মারা যান। ওসমানীতে যখন তিনি ভর্তি হন, তখনই কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তিনি যেদিন মারা যান, সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় জানা যায় তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ। পবন পাল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া হবিগঞ্জ জেলার প্রথম চা-শ্রমিক।
পবন মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যদেরও করোনা পরীক্ষা করানো হয়। কিন্তু, তারা কেউই করোনায় আক্রান্ত হননি। পবনের ভাতিজা অজয় সিংহ (২৪) জানান, পবনের সঙ্গে তিনি হাসপাতালগুলোতে গিয়েছেন। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্যে তিনি বাগান ব্যবস্থাপনা পরিচালিত ডিসপেনসারিতে গেলে কর্তৃপক্ষ তাকে নিজ উদ্যোগে পরীক্ষা করতে বলে। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষা করান এবং ফল নেগেটিভ আসে।
বাগান কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে যা করেছে, তা হলো মৃতের সৎকার এবং পবনের পরিবার ও কিছু আত্মীয়-স্বজন যারা তার সৎকার করেছেন তাদের খাবার রান্নার জন্য কিছু জ্বালানি কাঠ দিয়েছে ৫ আগস্ট। বাগান ব্যবস্থাপনার পরবর্তী সম্ভাব্য কাজ হলো পবনের স্ত্রীকে চা পাতা তোলার শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। ব্যস! কোম্পানি পবনের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু, এটুকুই কি যথেষ্ট?
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের এক লাখ নিবন্ধিত চা-শ্রমিকের একমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল মনে করেন, চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্যে মালিকের করণীয় আরও অনেক বেশি।
বাংলাদেশ শ্রমবিধি ২০১৫ অনুযায়ী, চা-বাগানের মালিককে অবশ্যই শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দিতে হবে। পবন পালের স্ত্রী পূরবী পাল বলেন, 'পবনের চিকিৎসায় মোট খরচ হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা (আইসিইউ বেড পেতে ৩০ হাজার টাকার ঘুষসহ)। মালিক কি তার চিকিৎসার খরচ পুরো বা আংশিক বহন করবে? আমরা জানিনা কীভাবে মালিকের কাছে চিকিৎসার খরচ চাইব।' চার জনের পরিবারের বর্তমানে একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য পূরবী।
পবন পালের পরিবারের এই দুর্ভোগ দেখিয়ে দিচ্ছে কোভিডে আক্রান্ত হলে চা-বাগানের মানুষ কত অসহায়। চা-শ্রমিকরা বলেন, বাগান ব্যবস্থাপনা শ্রমিকদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানোর বিষয়ে অনাগ্রহী। কিন্তু, কেন?
বিভিন্ন সূত্র জানায়, মালিকদের আশঙ্কা, পরীক্ষা করা হলে অনেকের কোভিড পজিটিভ আসবে। আর তা হলে পজিটিভ শ্রমিকদেরকে বেতনসহ অন্তত ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বা ছুটি দিতে হবে। তারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের ঝুঁকি স্বীকার করেন। কিন্তু, শ্রমিকদের জন্যে আর্থিক খরচ বহন করতে রাজি নয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী বলেন, 'বাগান ব্যবস্থাপনা টিকাদানের বিষয়ে আগ্রহী এবং শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের নিবন্ধনের জন্য সাহায্য করছে। তবে, করোনা পরীক্ষার বিষয়ে তারা মোটেও আগ্রহী নয়।'
সিলেট জেলার সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দীন মোর্শেদ বলেন, 'আমি চা-বাগানে টেস্টিং বুথ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ঢাকার বিশেষজ্ঞ কমিটি আমাকে তা না করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, তাদের আশঙ্কা, নমুনা সংগ্রহের সময় কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়বে। তাই অন্যদের মতো চা-শ্রমিকদেরকেও জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে নমুনা দিতে হবে।'
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কোভিড-১৯ পরীক্ষা ব্যয়বহুল নয়। জেলা অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষার খরচ ১০০ টাকা। কিন্তু, একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি যেখানে ১২০ টাকা, তার জন্যে এই টাকাটাই অনেক। এ ছাড়াও, এই পরীক্ষার জন্যে একজন চা-শ্রমিককে একদিনের ছুটি নিতে হবে, আছে যাতায়াত খরচ। তার ওপর যদি ফলাফল পজিটিভ হয়, তাহলে তার চিকিৎসার খরচ রয়েছে, যা একজন শ্রমিকের জন্যে বহন করা কষ্টকর।
ফলে যেসব চা-শ্রমিক নিজ উদ্যোগে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করেছেন এবং যাদের ফলাফল পজিটিভ এসেছে, তারা অনেক কঠিন সময় পার করেছেন। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার রাজনগর চা-বাগানের শ্রমিক হরি দাস (৬০) ১০ বছর ধরে বাগানের নিবন্ধিত শ্রমিক ও পাঁচ বছর ধরে ম্যানেজারের বাংলোতে অনিবন্ধিত কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শ্বাসকষ্ট-জনিত কারণে তার পরিবার তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে ৭ জুলাই তার কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসে। যেহেতু তিনি নিবন্ধিত শ্রমিক হিসেবে কর্মরত নন, তাই তাকে আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অসুস্থতার কারণে যতদিন কাজে অনুপস্থিত, ততদিন তার কোনো রোজগার নেই।
হাসপাতালে একরাতের অক্সিজেন খরচসহ তার দরিদ্র পরিবার ১৩ হাজার টাকা খরচ করেছে। এটা তার পরিবারের জন্যে বড় একটা ধাক্কা। তার ছেলে বাবুল দাস (২২) বলেন, 'অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের এই চিকিৎসা চালাতে হয়েছে। বাগান ব্যবস্থাপনা আমার বাবার চিকিৎসায় কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা করেনি।'
বাগান কর্তৃপক্ষ নিবন্ধিত শ্রমিকদেরও চিকিৎসা খরচ দেয় না, এমন অভিযোগ এখন শোনা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় সাধারণ ছুটি এবং লকডাউন বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু, চা-বাগান কখনো বন্ধ হয়নি। ঈদের জন্যে ২৩ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের ছুটির পর কঠোর লকডাউনের সময় পোশাক কারখানাসহ সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ ছিল, চা-বাগানের নিয়মিত কার্যক্রম তখন অব্যাহত থেকেছে। বাংলাদেশে চা বোর্ড এক বিজ্ঞপ্তিতে চা'কে 'খাদ্যদ্রব্যে'র তালিকায় ফেলে এর উৎপাদন ও বিপণন লকডাউনের আওতামুক্ত রাখে।
এক সময়ে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, চা-বাগানগুলো করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু, তারা ভুল প্রমাণিত হন। অভিযোগ আছে, চা-শ্রমিকদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে কোভিড-১৯ ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। চা-বাগানগুলো পুরোপুরি চালু রাখলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ ছিল অপর্যাপ্ত এবং সেই সঙ্গে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা একেবারে অপর্যাপ্ত। একদিকে মালিকপক্ষ নমুনা পরীক্ষা করাতে অনিচ্ছুক, অন্যদিকে শ্রমিকদের মধ্যেও মজুরি হারানোর ভয়ে রোগের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত অসুস্থতা লুকানোর প্রবণতা আছে।
আমরা চা-বাগানের এই পিছিয়ে পড়া এবং বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মহামারিতে আক্রান্তের পুরো চিত্র এখনো পাচ্ছি না। আশঙ্কার বিষয় হলো, লেবার লাইনের শ্রমিকদের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। সিলেটের নিকটবর্তী আসামে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সেখানকার চা-বাগানগুলোতে মৃত্যু অনেক বেড়েছে।
নর্থ-ইস্ট টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামের চা-বাগানে ২০২১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের সময় আসাম ও বাংলাদেশ এলাকার চা-বাগানগুলোতে মৃত্যু খুব কম ছিল। যা বর্তমান কোভিড-১৯ ঢেউয়ে বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চা-শ্রমিক সম্প্রদায়ের প্রতি সরকার ও মালিকপক্ষের বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম, বাগান পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ এবং চা-পাতা তোলা, জমা করা ও চা তৈরির সব পর্যায়ে সঠিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো সেখানে জরুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। চা-শ্রমিকরা শতাধিক বছর ধরে মালিকদেরকে (যাদের মধ্যে সরকারি সংস্থাও আছে, যাদের বাগানে সংখ্যা ১৭টি) অনেক মুনাফা ও স্বস্তি দিয়েছেন। বর্তমান সংকটে মালিকপক্ষের উচিত সুবিধাবঞ্চিত শ্রমিকদেরকে নমুনা পরীক্ষা ও টিকাদানে বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা।
ফিলিপ গাইন, গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (শেড) পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments