মুজিবের ‘ব’ কেটে ফেলার স্পর্ধা

বাঙালির ইতিহাস থেকে সব নাম বাদ দেওয়া গেলেও যে নামটি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না, সেটি হচ্ছে 'মুজিব'। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম মুজিব। মাটি, দেশ, মানুষ, বাঙালি, বাংলাদেশ, পতাকা, স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুলোর মতোই পবিত্র। এই নাম মানুষের হৃদয়ের গহীনে প্রথিত।
বাঙালির রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা নাম মুজিব। শেখ মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের কালো অক্ষর থেকে তার নাম বাদ দেওয়া গেলেও মানুষের মন থেকে এই নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয় কোনোদিন। অথচ তার জন্ম শতবর্ষে, বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর দিনে, তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা মঞ্চেই দেখা গেল মুজিবের নাম থেকে 'ব' উধাও।
'মুজিববর্ষ'কে লেখা হয়েছে 'মুজিবর্ষ'। মুজিবের নাম থেকে 'ব' কেটে ফেলার এই স্পর্ধা কার? মুজিব থেকে 'মুজি' আর 'বর্ষ' মিলিয়ে বানানো হয়েছে 'মুজিবর্ষ'। অথবা এটাকে সন্ধির মতো করা হয়েছে যে মুজিব+বর্ষ=মুজিবর্ষ। কোনো যুক্তিতেই এটা খাটে না। এটা হাস্যকর। এটা ঔদ্ধত্য। এটা অপরাধ। ব্যাকরণসম্মত হলেও মুজিবের নাম থেকে 'ব' বাদ দেওয়া মানে মুজিবকে অসম্মান করা। শেখ মুজিবকে অসম্মান করা মানে বাংলাদেশকে অসম্মান করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অসম্মান করা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির তরফে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এ রকম: 'আমরা একটি চিপ-এ পিসি থেকে ট্রান্সফার করে লেখাটি উৎকীর্ণ করেছি। ডিভাইস ট্রান্সফারের একপর্যায়ে একটি 'ব' অক্ষর অমিট হয়ে গেছে। আমরা পিসিতে চেক করে দেখেছি এটা ঠিকই আছে। অ্যাডভান্স টেকনোলজির বিষয়টি হয়তো স্যুট করেনি। এলইডিতে পরিস্ফুটন করে লেখাটি তোলা হয়েছে। পেডিয়ামের মনিটরেই আমরা ত্রুটিপূর্ণ বানান দেখতে পাই। এমন প্রাযুক্তিক গোলমালের বিষয়টি দৃষ্টিতে আসার পরপরই নামাজের বিরতিতে ত্রুটি সারাই করা হয় মাধ্যমটি পরিবর্তন করে। অর্থাৎ প্রথমে এলইডিতে পরে ম্যানুয়ালি উৎকীর্ণ করা প্লেট প্রতিস্থাপন করে।'
এই ব্যাখ্যাটি স্পষ্টতই দায়সারা, হাস্যকর এবং স্ববিরোধী। কারণ ঘটনাটি যে ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় স্থাপিত বিজয়মঞ্চেই ঘটেছে তা-ই নয়, বরং একাধিক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এমনকি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রেও গত বছরের মার্চ থেকে 'মুজিবর্ষ' শব্দটি লেখা হচ্ছে।
গত বছরের ১২ মার্চ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটটের একটি সংশোধিত পরিপত্রে 'মুজিবর্ষ' লেখা হয়েছে। গত ৩১ মে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও 'মুজিবর্ষ' লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও লেখা হয়েছে 'মুজিবর্ষ'। গত ২১ জুন রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বিএসএসএর শিরোনাম: 'মুজিবর্ষ উপলক্ষ্যে ঝিনাইদহে দ্বিতীয় পর্যায়ে বসতবাড়ি পাচ্ছে ৭০৫টি ভূমিহীন পরিবার।'
গত ৭ জানুয়ারি দৈনিক সমকালের শিরোনাম: 'মুজিবর্ষের সেরা উপহার।' গত বছরের ১৭ মার্চ বিডিনিউজের শিরোনাম: 'মুজিবর্ষের স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত।'
তার মানে গত বছরের মার্চ মাসে কিংবা তারও আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মুজিববর্ষকে 'মুজিবর্ষ' লেখা হবে। যদিও তখন হয়তো বিষয়টি নিয়ে সেভাবে সমালোচনা হয়নি। কিন্তু যখন সমালোচনা শুরু হলো, তখন ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, এটা প্রযুক্তির সমস্যা। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রসহ দেশের অনেক প্রথম সারির সংবাদপত্রেও যখন 'মুজিবর্ষ' লেখা হলো তখন এটা সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের চোখে পড়েনি? বাস্তবতা হলো, 'মুজিবর্ষ' শব্দটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি সচেতনভাবেই লিখেছে এবং ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়মঞ্চেও সচেতনভাবেই 'মুজিবর্ষ' লেখা হয়েছে।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে তাৎক্ষণিকভাবে এর একটি ব্যাখ্যা হাজিরের চেষ্টা করা হচ্ছে। তার মানে মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি বা সরকারের পরামর্শ ছাড়া কোনো দায়িত্বশীল সংবাদপত্র 'মুজিববর্ষ' থেকে একটি 'ব' হাওয়া করে দিতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ জায়গার সিদ্ধান্ত ছাড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও 'মুজিবর্ষ' লেখার কোনো কারণ নেই। এখন 'ঠেলায় পড়ে' যে প্রযুক্তির দোহাই দেওয়া হয়েছে, সেটি প্রযুক্তি সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনিও বুঝবেন, এটা নির্জলা মিথ্যাচার। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস।
কিন্তু মাছের সাইজ বড় হলে কিংবা শাকের পরিমাণ কম হলে মাছ ঠিকই বেরিয়ে আসে। এসেছেও তা-ই। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১০ জানুয়রি মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনার দিনেও জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লেজার রশ্মি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিকৃতি তৈরি করা করা হয়েছিল, সেটি নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল। কারণ ওই লেজার রশ্মিতে বঙ্গবন্ধুর বিমান থেকে নামার যে দৃশ্য তৈরি করা হয়েছিল, সেটি ছিল অত্যন্ত দুর্বল একটি কাজ। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যায়নি। এটি নিয়েও তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সমালোচনা হয়।
ঘটনার দিন রাতেই আমার সাবেক কর্মস্থল চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে রাত সাড়ে ১১টার লাইভ শো 'মুক্তকণ্ঠ' অনুষ্ঠানে বিষয়টি নিয়ে উদযাপন কমিটির প্রধান কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তখন বলেছিলেন, 'পারফেকশনের কোনো শেষ নেই। আপনি যাই করবেন সেটার সমালোচনা হতেই পারে। পুরো বিষয়টা আপেক্ষিক। টেকনিক্যাল বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত না হয়ে আমরা অনেক সময় মন্তব্য করি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এটি হচ্ছে ক্ষণ গণনার শুরু। মূল প্রোগ্রাম নয়।
তা ছাড়া, আমরা বঙ্গবন্ধুর বিমান থেকে নামার দৃশ্যটি একটা আলোক প্রক্ষেপণ করতে চেয়েছি। অনেকে হলোগ্রাফিক প্রেজেন্টশনের সঙ্গে এটাকে গুলিয়ে ফেলছেন।' (উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের লিংকটি ইউটিউবে রয়েছে।)
প্রশ্ন হলো এগুলো কি নিছকই অদক্ষতা, বেখেয়াল, অসতর্কতা? কারণ রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব অনুষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। ফলে প্রশ্ন ওঠে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে কী বানানো হচ্ছে? কারা বানাচ্ছেন? কত টাকার ঠিকাদারিতে কত টাকার কাজ হচ্ছে? এটা তো পিচঢালা রাস্তা নয় যে বিটুমিন একটু কম দিলেও ক্ষতি নেই। এটা মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশের জয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। এখানে মশকরার সুযোগ থাকা উচিত নয়!
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments