মুরাদের অচিন্তনীয় নারীবিদ্বেষ 

তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে মুরাদ হাসানকে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশের ভিত্তিতে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এই উদ্যোগে সারা দেশের যেসব নারী একাগ্রচিত্তে ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করছিলেন, তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তার মন্ত্রিসভায় এরকম সদস্যের কোনো স্থান নেই, যারা উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে এরকম কুৎসিত ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে পারেন। বিশেষ করে সে মন্তব্যে কী পরিণতি হতে পারে সে বিষয়ে একটুও চিন্তা না করে নারীদের অসম্মান করার প্রবণতা দেখা যায়। 
ইলাসট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে মুরাদ হাসানকে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশের ভিত্তিতে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এই উদ্যোগে সারা দেশের যেসব নারী একাগ্রচিত্তে ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করছিলেন, তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তার মন্ত্রিসভায় এরকম সদস্যের কোনো স্থান নেই, যারা উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে এরকম কুৎসিত ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে পারেন। বিশেষ করে সে মন্তব্যে কী পরিণতি হতে পারে সে বিষয়ে একটুও চিন্তা না করে নারীদের অসম্মান করার প্রবণতা দেখা যায়। 

যাদের সাম্প্রতিক বিতর্কিত ঘটনাগুলো সম্পর্কে ধারণা নেই, তাদের জন্য সংক্ষেপে বলছি। প্রায় ৬ দিন আগে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রীর প্রথম ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তাকে একটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি একজন মডেলকে মঞ্চে আহ্বান করেন এবং তার 'জিরো ফিগার' নিয়ে মন্তব্য করেন। তার এই 'বুদ্ধিদীপ্ত' হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াসে উপস্থিত দর্শকদের একটি অংশ হেসে ওঠেন এবং যার উদ্দেশ্যে তিনি এ মন্তব্য করেন, সে মডেল স্পষ্টতই বিব্রত হন। এক পর্যায়ে মুরাদ তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠেন। এ ধরনের আচরণ কোনোভাবে একজন মন্ত্রিসভার সদস্যের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। তবে একইসঙ্গে, এ রকম আচরণ করে কেউ বরখাস্ত হবেন, এটাও আমরা আশা করি না, কারণ আগে এ দেশের পুরুষরা এর চাইতেও আরও অনেক খারাপ আচরণ করে পার পেয়ে গেছেন। 

একদিন পর দ্বিতীয় ভিডিওটি প্রকাশ হয়, যেখানে তিনি বিএনপি নেত্রীর নাতনীর প্রসঙ্গ তোলেন এবং তার নামে খুব খারাপ ভাষায় কুৎসা রটান। অন্য আরও অনেক আপত্তিকর কথার পাশাপাশি তিনি একই সঙ্গে নেত্রীর ছেলের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন (আপনারা হয়তো ভাবছেন, এরকম স্বনামধন্য পত্রিকায় কেন এ ধরনের কথাবার্তা লেখা হচ্ছে। বিষয়টা হলো, একজন মন্ত্রিসভা সদস্যের মুখ থেকে এ ধরনের কথাবার্তা শুনেও কেউ অভ্যস্ত নন)। তার মন্তব্যগুলো ক্রমশ আরও জঘন্য হতে থাকে এবং মুচকি হেসে বারবার তাকে উস্কে দিতে থাকেন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ব্যক্তিটি, যিনি নাহিদরেইনস পিকচার্স নামে একটি ফেসবুক পেজের পরিচালনা করেন। তবে পরবর্তীতে তিনি তার অবস্থান পুরোপুরি পরিবর্তন করেছেন। তিনি এমন কি মুরাদের 'উগ্রতা ও অশ্লীলতা' সহ্য না করার জন্য সরকারকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে মুরাদ তার অশ্লীল কথা বলার পারদর্শিতা নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন এবং জানান, তিনি চাইলে এতটাই অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে পারবেন, যা শুনলে শ্রোতাদের কানের পর্দা ফেটে যাবে। একজন সংসদ সদস্যের কাছ থেকে আসা কী নির্মম দম্ভ!

প্রত্যাশিতভাবে, দেশের নারীবাদী সংগঠনগুলো মুরাদের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং তার মন্তব্যের প্রতি নিন্দা জানায়। তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নারীপক্ষ জানতে চায়, 'কীভাবে একজন জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রিসভার সদস্য এ ধরনের নারীবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী মন্তব্য করতে পারেন এবং কীভাবে তিনি এই মন্তব্য নিয়ে গর্ববোধও করতে পারেন?' তাদের বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা একাত্মবোধ করলেও, অনেকেই ভেবেছি, এই ঘটনাগুলো কি মন্ত্রীকে বিপদে ফেলার জন্য যথেষ্ট হবে? যে দেশের গণতন্ত্র চর্চার সর্বোচ্চ মঞ্চে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ সদস্য দাবি করতে পারেন, অবশ্যই ধর্ষণের সঙ্গে সাবলীল পোশাক পরে রাস্তায় বের হওয়া এবং অতিরিক্ত স্বাধীনতা পাওয়ার সম্পর্ক আছে, একজন মাননীয় বিচারক বলেছেন, 'তারা ঐচ্ছিক যৌন মিলনের অংশীদার ছিলেন, কারণ তারা স্বেচ্ছায় পার্টিতে গেছেন, নেচেছেন, মদ্যপান করেছেন এবং পুলে সাঁতার কেটেছেন', সেখানে কি একজন প্রতিমন্ত্রী শুধুমাত্র কিছু আপত্তিকর ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য শাস্তি পাবেন? নাকি এই আচরণকে 'পুরুষ মানুষ একটু এরকম করেই' (পড়ুন: পুরুষ মানুষ বিষাক্ত ও নারীবিদ্বেষী আচরণ করলেও দায়মুক্ত থাকেন) অজুহাত দিয়ে মেনে নেওয়া হবে?  

মুরাদ সংক্রান্ত বিষয়টির কফিনে শেষ পেরেক ছিল দুজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে তার ফোনালাপ ফাঁস হওয়া। এই কলের বিস্তারিত এখানে পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়, তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি ফোনে যা বলেছেন, তা যৌন সহিংসতার হুমকি দেওয়ার পর্যায়ে পড়ে। গত সোমবার থেকে এই ভয়েস ক্লিপ সবার মোবাইলে ঘুরছে এবং সঙ্গে এই বিতর্কিত ও সুপরিচিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমালোচনা বেড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের মাঝে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি, এত কিছুর পরেও কি দলের নেতারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না? মুরাদ হাসান নামের নাটকের যবনিকাপাত কী হতে যাচ্ছে, অবশেষে? 

আবারো আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাই আমাদের আশংকাকে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য। এ ক্ষেত্রে, আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতে চাই, কারণ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রাথমিক মন্তব্য আমাদের হতবাক করেছিল। তিনি বলেছিলেন, মুরাদের মন্তব্য 'ব্যক্তিগত' এবং তা দল বা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায় না। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। 

অর্থাৎ, এ বিষয়ে প্রাথমিক বক্তব্য দেওয়ার সময় দলের একজন প্রতিনিধি ক্ষুদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ দেখতে পাননি, তাই স্বভাবতই আমরা বাধ্য হচ্ছি জিজ্ঞাসা করতে, মুরাদ হাসানের কী যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে? যখন তার মন্তব্যগুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল, তখন গণমাধ্যমে মুরাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল 'মাফ চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।' প্রথমত, তিনি একজন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কদর্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখেছেন। কোনো সভ্য সমাজের রাজনীতিতে এ ধরনের ভাষা ও বাগাড়ম্বরের কোনো স্থান নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উত্তপ্ত ও চরম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ হলেও এ ধরনের কথাবার্তা মেনে নেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, তার প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তিনি একজন অভিনেত্রীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে অপহরণ করানোর হুমকি দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি এমন সব মানুষকে কাজে লাগানোর হুমকি দিয়েছেন, যাদের কাজই হচ্ছে এ ধরনের অপরাধ থেকে মানুষকে বাঁচানো। একজন সংসদ সদস্য হয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে দাবি করেছেন যে তিনি চাইলে তার রাষ্ট্রপ্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের বিচার ব্যবস্থার সহায়ক শক্তিগুলোকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন এবং তাদের মাধ্যমে দেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধও করতে পারেন। 

এই একই মানুষকে কী আবারো সংসদে দাঁড়িয়ে আমাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে দেওয়া হবে? এ ধরনের কিছু হলে, তা আমাদের দেশের নেতাদের ব্যাপারে কী বলবে এবং আমাদের সংসদ অধিবেশনের পবিত্রতাই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এর মানে কী এটাই, যে মুরাদের মতো আরও মানুষকে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হবে, বা আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে, ইতোমধ্যে এরকম আরও মানুষ আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আছেন? যদি বিষয়টা এরকমই হয়, আমাদের যদি এ ধরনের নীতিনির্ধারক থেকে থাকেন, যারা মুরাদের মতো মানুষদের সঙ্গে একই কক্ষে বসতে রাজি থাকেন, যারা এমন সব রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মেনে নিতে রাজি আছেন যারা নারীদের সম্মান দেওয়া তো দূরে থাকুক, তাদেরকে মানুষই মনে করেন না, তাহলে কীভাবে আমরা আশা করবো দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কোনোদিন সমঅধিকার পেতে পারি?  

আমি আরও একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। যখন মুরাদ হাসান অনলাইনে সহিংস ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করছিলেন, তখন তার পেছনে প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার ছবি ঝোলানো ছিল। আমাদের মনে রাখা উচিত যে তিনি শুধু সরকারের প্রতিনিধিই নন, তিনি একইসঙ্গে এমন একটি দলের প্রতিনিধি, যে দলের শিকড় খুঁজতে গেলে আমাদেরকে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে জাতি হিসেবে আমরা কোন অবস্থানে থাকি, যদি মুরাদের মতো লোকেরা বঙ্গবন্ধুর দলের সদস্য থাকেন?

সুপ্রভা তাসনীম: দ্য ডেইলি স্টারের এডিটোরিয়াল টিমের সদস্য

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Workers rights vs corporate profits

How some actors gambled with workers’ rights to save corporate profits

The CSDDD is the result of years of campaigning by a large coalition of civil society groups who managed to shift the narrative around corporate abuse.

10h ago