রুশ-ইউক্রেন: তথ্যের বিশ্বযুদ্ধে বাংলা ছাপ

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে মিডিয়ার এক নয়া বৈশ্বিক রূপ। সরগরম দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম। তা প্রতিষ্ঠিত ও মূলধারার কোনো কোনো গণমাধ্যমেও। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর জন্য মওকা। যা ইচ্ছে কনটেন্ট, সেগমেন্ট প্রচারের উদ্দাম দৌড়। বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো থেকে ধার করা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশেও রিপোর্টিংয়ের ছড়াছড়ি। তথ্যের হেরফের যাচাই বা তুলনার বালাই কম। সুযোগও কম। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এগুলোর অডিয়েন্স (পাঠক-দর্শক-শ্রোতা) প্রচুর। বেশুমার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দেশ-বিদেশের বহু গণমাধ্যমে ভুয়া ছবি-ভিডিও দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে মিডিয়ার এক নয়া বৈশ্বিক রূপ। সরগরম দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম। তা প্রতিষ্ঠিত ও মূলধারার কোনো কোনো গণমাধ্যমেও। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর জন্য মওকা। যা ইচ্ছে কনটেন্ট, সেগমেন্ট প্রচারের উদ্দাম দৌড়। বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো থেকে ধার করা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশেও রিপোর্টিংয়ের ছড়াছড়ি। তথ্যের হেরফের যাচাই বা তুলনার বালাই কম। সুযোগও কম। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এগুলোর অডিয়েন্স (পাঠক-দর্শক-শ্রোতা) প্রচুর। বেশুমার।

আধা সত্যকে পূর্ণ সত্য, সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে প্রচারের ডিজিটাল রোগটি রুশ-ইউক্রেন সংঘর্ষেও ভর করেছে। তথ্য প্রযুক্তির অতি কল্যাণে এ ধরনের সংবাদ, ছবি, ভিডিও দ্রুত ছাড়ানো যাচ্ছে। এমন সঙ্গিন সময়ে মানুষ তাৎক্ষণিক কেবল গ্রহণ নয়, শেয়ারও করছে হাজারে-হাজার, লাখে-লাখ। তাদের কার্যত কর্তৃপক্ষ নেই। সংবাদমাধ্যমের মতো তথ্য-ফুটেজ ব্যাপকভাবে যাচাই করতে হয় না। আবার মূলধারার গণমাধ্যমও দ্রুত তথ্য সরবরাহের প্রতিযোগিতায় প্রায়ই ভর করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। এর জেরে এ যুদ্ধের রকমারি তথ্য চালান করতে গিয়ে এরইমধ্যে হত্যা-বম্বিং, রক্তভেজা রাজপথ, বিধ্বস্ত বিমানের ফেক ছবির ঘটনাও ধরা পড়েছে কয়েকটি। কিন্তু তা তেমন ধোপে টিকছে না। গলদ বোঝার সময় নেই মানুষের। কেবল রাশিয়া-ইউক্রেন নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন শক্তিমান দেশের সামরিক সামর্থ্য নিয়ে ইনডেপথ রিপোর্ট বাজারজাতেরও মৌসুম পড়েছে। দেশগুলো কে কার দিকে? কার কতো অস্ত্র-গোলাবারুদ, কতো যুদ্ধবিমান? কতো যুদ্ধবাজ সেনা, গোয়েন্দা, কমান্ডো? কারা বেশি দুর্ধর্ষ? এসবের পিলে চমকানো তথ্যসহ এন্তার বিশ্লেষণ। কোনোটিতে ইউক্রেন সংকট চিত্রিত হচ্ছে একভাবে। কোনোটিতে আরেকভাবে। রাশিয়া সমর্থিত দেশগুলোর মিডিয়াতে আরেক রকম। মধ্যপন্থী দেশগুলো মধ্যম পথে থাকছে না। ঝুঁকছে কোনো না কোনো দিকে। এতে সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক হয়ে পড়ছে।

রাশিয়া না থাকলে বিশ্ব থেকে কী লাভ, রাশিয়া পরাস্ত হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রই নাই হয়ে যাবে- এ ধরনের কথামালা বিশ্বনেতাদের কারও কারও বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর ভর করেই মানুষের কাছে আসছে। তা মানুষের আলোচনার খোরাক জোগান দিচ্ছে। তবে সব অডিয়েন্সের তথ্য ক্ষুধা মেটাচ্ছে না। উপরন্তু বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আর প্রশ্ন তো জাগছেই। এর কারণ নানাবিধ। অন্যতম এক কারণ- চীন-রাশিয়া পরাক্রমশালী সুপার পাওয়ার হলেও তাদের সুপার পাওয়ার মিডিয়া নেই। পশ্চিমা মিডিয়াকে তারা সোজা কথায় গুজবের বক্স বললেও কাউন্টার তথ্য সরবরাহ করতে পারছে না। এতে অনিবার্যভাবে বিবিসি, সিএনএন, ভয়েস অব আমেরিকা, আলজাজিরা, রয়টার্স, এপিসহ প্রভাবশালী প্রায় সব মাধ্যমের তথ্যেই একমুখীতা। কখনো কখনো একতরফা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিকও। যেখানে রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেনের গুরুচরণ দশার তথ্য আছে। রয়েছে ইউক্রেনের মারে রাশিয়ার পালানোর পথ খোঁজার অবস্থার তথ্যও। যার মধ্যে বাংলাদেশের তথ্য জগতের স্ট্যান্ডার্ডের ছাপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তোড়ে চলমান স্ট্যান্ডার্ডেও ছেদ পড়ছে। খুলছে ভুল বোঝাবুঝির দুয়ার। এরইমধ্যে সেনা সদস্যদের আগের মহড়া বা পৃথিবীর অন্য কোথাও সংঘটিত পুরনো যুদ্ধের ভিডিও চাউর হয়েছে বর্তমানের ঘটনা বলে। মস্কোর বিজয় দিবসের প্যারেডের ২০২০ সালের ভিডিও ফুটেজকে পর্যন্ত সাম্প্রতিক বলে চালিয়ে দেওয়ার ক্রিয়াকাণ্ড ঘটেছে।

আরেকটি ভিডিওতে আসল অডিওর ওপর সাইরেনের আওয়াজ জুড়ে দিয়ে এটিকে ইউক্রেনের আকাশসীমায় রুশ বোমারু বিমানের অভিযান বলে চালানো হয়েছে। আরেকটি ভিডিও ক্লিপে খারকিভ শহরে রুশ প্যারাট্রুপারদের অবতরণের কথা জানানো হয়েছে। তা মূল ধারার গণমাধ্যমেও প্রচার হয়েছে। টুইটারে দেখা গেছে লাখ লাখ বার। রুশ ভাষার ওই ভিডিওটি প্রথম ইন্টারনেটে আসে ২০১৬ সালে। ২০১১ সালের বেনগাজিতে বিদ্রোহীদের গুলিতে লিবিয়ার বিমান ভূপাতিতের দৃশ্য দিয়ে প্রচার হয়েছে ইউক্রেনে রুশ বিমান ভূপাতিত করার তথ্য। বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের ভিডিওকেও সম্প্রতি ইউক্রেনের ঘটনা বলে চালানোর ঘটনা বাদ পড়েনি। বিবিসির নিজস্ব অনুসন্ধানে এগুলোর কিছু কিছু খোলাসা হয়েছে। যার জেরে টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এগুলোর কিছু কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রচারের কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার ওপর যোগ হচ্ছে নতুন প্রচারণা।

রাশিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ বা পীড়নে রাখার একটি পরিণতি এখানে শিরোধার্যের মতো কাজ করেছে। তথ্য প্রচার করতে না দিয়ে ধামাচাপা রাখার এমন পরিণামের কথা সাংবাদিকতার পাঠ-পঠনেও রয়েছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে যা টাটকা প্রমাণ। রাশিয়ান মিডিয়া নিজ দেশে সরকারের প্রচারণা বক্স হিসেবে উপেক্ষিত সেই কবে থেকেই। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এ সুযোগটা নিয়েছে। তারা খড়গহস্ত হয়েছে রাশিয়ান মিডিয়ার ওপর। তারা উদাহরণসহ বিশ্বব্যাপী বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রমাণ করে ছাড়ছে রুশ মিডিয়া মানেই প্রোপাগান্ডা, ভুয়া খবর। তা পশ্চিমারা কেবল প্রতিষ্ঠাই করেনি, নিজ নিজ দেশে রাশিয়ান মিডিয়ার প্রচার-সম্প্রচার বন্ধও করে দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়াও চটে। নিজস্ব সংবাদমাধ্যমগুলোকে অবারিত বা বিশ্বাসযোগ্য করার পথে না গিয়ে বরং আরও কঠোর হয়েছে। ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে মস্কোসহ রাশিয়ার ৫৪টি শহরে নিজ দেশের সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ-মিছিলের খবরও প্রকাশ হতে নারাজ পুতিন সরকার। তা জানতে হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যম থেকে। রাশিয়া নতুন করে চড়াও হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ওপর। শুরুতে নিষিদ্ধ করে জার্মানভিত্তিক ডয়েচে ভেলে এবং 'রেডিও ফ্রি ইউরোপ'কে। পরে বন্ধ করে দিয়েছে সিএনএন-ভয়েস অব আমেরিকার মতো পশ্চিমা আরও কয়েকটি গণমাধ্যম। শেষমেশ ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারকেও যুদ্ধাহত করে টুটি চেপে দিয়েছে। যার অনিবার্যতায় আরও তেজি হয়েছে ইনফরমেশন ওয়ার। গুজব, প্রোপাগান্ডা তথা রং মাখানো সংবাদের বাজার গরম হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই 'ইনফরমেশন ওয়ার'র স্বরূপ সচেতনদের কাছে উপলব্ধিযোগ্য। এ ধরনের তথ্য জোগান ও বাজারজাত মোটেই কঠিন নয়, তবে একবার শুরু হলে শেষ করা কঠিন। বরং ফুলে-ফেঁপে তা আরও চাঙ্গা হয়। ছড়ায় ভাইরাসের মতো। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, স্থানীয় যেকোনো ঘটনা নিয়ে গড্ডালিকায় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমন প্রোপাগান্ডার বাহন রোখা কঠিন। কেবল দেশে-বিদেশে নয়, বিশ্বের এক মেরু থেকে আরেক মেরুতেও।

মোস্তাফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

15h ago