রেহানা মরিয়াম নূর: ধূসর মনস্তত্ত্ব এবং কর্তৃত্ববাদের চিত্রায়ন

রেহানা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রটি চিন্তা উদ্রেককারী এবং শিক্ষামূলক একটি অসাধারণ ছবি। গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং বাহুমাত্রিক এই ছবিতে দেখা যায় ডা. রেহানা একজন মেডিকেল কলেজের শিক্ষক, সে বিধবা এবং এক শিশু সন্তানের মা। মা-বাবা, বেকার ভাই এবং কন্যা ইমুকে নিয়ে তার বসবাস। পরিবারে সে একমাত্র উপার্জনকারী। একদিকে পেশাগত দায়িত্ব, অন্যদিকে বাচ্চা লালন-পালন, মা-বাবা এবং ভাইয়ের প্রতি সে দায়িত্ব পালন করে। রেহানার অভিব্যক্তিতে সবসময় এক ধরনের অস্থিরতা এবং বিষণ্ণতা। কথা-বার্তা, আচার আচরণে সে অনমনীয়, অল্পতে বিরক্ত, একরোখা এবং কিছুটা আক্রমণাত্মক। রেহানার এমন মন-মেজাজ এবং আচরণের, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে তার সিদ্ধান্তের রেশ দর্শকের চিন্তায় প্রবাহিত করে ছবিটি শেষ হয়।
এই সিনেমার পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তিনি রেহানার মনস্তত্ত্বের বিষয়টি দর্শকের ভাবনায় ছেড়ে দিয়েছেন। তার ভাষ্যে আরও জানা যায় তিনি নারীবাদ বা রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেননি বরং একজন জেদি, একগুঁয়ে নারীর আবেগ, আচার-আচরণ এই সিনেমার উপজীব্য। এই ছবিকে আমারও নারীবাদী ছবি মনে হয়নি যদিও নারীবাদের সামান্য অংশ এখানে বিদ্যমান। আমার দৃষ্টিতে নারীবাদী, পেশাজীবী, মা, বোন এসব পরিচিতির আগে রেহানা একজন ব্যক্তি, রক্তে মাংসে মানুষ। তাই অন্য যেকোনো মানুষের মতোই তিনি ভালো মন্দ আবেগ দ্বারা তাড়িত। আমার মতে এই ছবিটিতে কর্তৃত্ববাদ এবং রেহানার ধূসর মনস্তত্ত্ব অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন: ছবির শুরু থেকেই রেহানার চোখে মুখে চাপা কষ্ট, বিষণ্ণতা স্পষ্ট, তার মনোজগৎ অস্পষ্ট এবং দোদুল্যমান। স্বামী হারানোর দুঃখবোধ রেহানার বিষণ্ণতার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে রেহানা তার স্বামীর স্মৃতি বহন করে চলে। এতে মনে হয় সে এখনো শোকগ্রস্ত এবং নিঃসঙ্গ বোধ করে (প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কের ক্ষেত্রে)। প্রিয়জন হারানোর গভীর শোক এবং মনোবেদনা লাঘবে ঠিকমতো ব্যবস্থা না নিলে অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। রেহানার জীবনে এই অনুভূতির সঙ্গে যোগ হয় প্রাত্যহিক জীবনের মানসিক চাপ এবং এতে তার আবেগ-অনুভূতি পিষ্ট হতে থাকে। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন সহকর্মী ডা. আরেফিনের অবমূল্যায়নমূলক আচরণ এবং কর্তৃত্ব রেহানার মনোকষ্টের আরেকটি কারণ। এসব কারণের প্রতিক্রিয়ায় রেহানাকে প্রায় সবার সঙ্গেই অনুপযুক্ত আচরণ করতে দেখা যায়।
এই ছবিটা কিছুক্ষণ দেখার পরই মনে হয় রেহানা বার্নআউটে ভুগছে। অর্থাৎ পেশাজীবন, পরিবার এবং বাচ্চা প্রতিপালনে সে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে সংগ্রাম করছে। বার্নআউট হচ্ছে ক্রমাগত ব্যস্ততার কারণে এক ধরনের নিঃশেষিত অবস্থা বা ক্লান্তি, এর পরও কাজ যথেষ্ট করা হচ্ছে না ভেবে উদ্বিগ্ন অনুভব করা। তবে বার্নআউট নির্ণয়যোগ্য মানসিক রোগ নয়, বরং এটা অপ্রতিরোধ্য চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি মানসিক অবস্থা। 'বার্নআউট: দ্য সিক্রেট টু আনলকিং দ্য স্ট্রেস সাইকেল' বইয়ের রচয়িতা ডা. এমিলি নাগোস্কি ও ডা. এমেলিয়া নাগোস্কি মনে করেন বার্নআউট এবং অন্যান্য অনেক অনুভূতি যেমন হতাশা, উদ্বেগ, শোক, রাগ এবং চাপা ক্রোধ একটার সঙ্গে অন্যটা জড়িত; যে অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই রয়েছে। সাইকোথেরাপিস্ট অ্যানড্রিয়া ব্র্যান্ডটের মতে ক্রমাগত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস-এ স্ট্রেস হরমোন শরীর প্লাবিত করে মানুষের মস্তিষ্কের যৌক্তিক চিন্তার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। রেহানার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি লক্ষণীয়। যেমন: ছাত্রীর প্রতি যৌন হয়রানীর প্রতিবাদে তার অবস্থান ইতিবাচক কিন্তু যৌক্তিক কৌশল প্রয়োগে রেহানার দুর্বলতা স্পষ্ট। ফলে সে খুব সহজেই অভিযুক্ত সহকর্মীর কুটচাল এবং প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির শিকার হয়, যার মূলে কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। এ ঘটনায় রেহানার ধূসর আবেগ আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ অবমূল্যায়ন, অন্যায়, অবিচার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং রেহানার ক্ষেত্রে সেই চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ছবির দ্বিতীয় অংশে। দ্বিতীয় অংশে রেহানার ছয় বছরের মেয়ে ইমুর আচরণের বিরুদ্ধে স্কুল থেকে অভিযোগ করা হয়। সেই অভিযোগকে কেন্দ্র করে রেহানা স্কুলের সঙ্গে বিবাদে জড়ায়। সে তার যুক্তিতে অনড় থেকে শেষ পর্যন্ত এক কঠোর, অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নেয়। বলাই বাহুল্য, স্কুল এবং ইমুর প্রতি রেহানার আচরণে কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতা প্রকাশ পায়। পুরো ছবিতে দেখা যায় পরিস্থিতি ভেদে দুর্বলের উপর সবলের কর্তৃত্ব।
এই ছবিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একজন নারীর বহুমাত্রিক আবেগ অনুভূতি চিত্রায়ন করা হয়েছে। তবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এরকম আবেগ অনুভূতি ধারণ করে। আমাদের দেশে মানুষের আবেগ অনুভূতি এবং এর কারণকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীর ক্ষেত্রে তা আরও অবহেলিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক আবেগ অনুভূতির লক্ষণ এবং এর প্রভাব নিয়ে সমালোচনা হয় কিন্তু এর উৎস অনুসন্ধান করে প্রতিরোধ বা প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সারা বিশ্বেই লেখাপড়া জানা অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন না। যেমন: এই ছবিতে আমরা দেখি কলেজের প্রিন্সিপাল রেহানাকে আর্থিক প্রণোদনার প্রস্তাব দিচ্ছেন, অথচ রেহানার বেশি দরকার বিশ্রাম এবং মনোযোগ। আবার অসুস্থ রেহানাকে দেখতে এসে তার আত্মীয়রা ক্রমাগত আলাপচারিতা করে যাচ্ছে, রেহানার কথা কেউ শোনার প্রয়োজন মনে করছে না। বাস্তবে ঠিক এমনটাই হয় যা এই ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দুঃখজনকভাবে মানসিক ব্যাধিকে অনেকে মানসিক অসুস্থতা হিসাবে চিহ্নিত করে ভুক্তভোগীর সমালোচনা করে। প্রায় সবাই জীবনের কোন না কোন সময় মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন: সম্প্রতি ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার ক্রিকেটার বেন স্টোকস্ তার মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটি নিয়েছেন। জাপান অলিম্পিকে আমেরিকান জিমন্যাস্ট সাইমন বিলিস নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে নারীদের টিম ফাইনালে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন।
বিষয়বস্তু এবং নির্মাণ কৌশল, উভয় দিক থেকেই রেহানা মরিয়ম নূর একটি অনন্য চলচ্চিত্র। অসাধারণ অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন, আফিয়া জাহিন জাইমা এবং কাজী সামি হাসান। আসলে সব শিল্পীই সাবলীল অভিনয় করেছেন। নীল আলোর ব্যবহার, ক্যামেরার কাজ এবং একই বদ্ধ সেট এর ব্যবহারে দর্শককে রেহানার বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ এবং কর্মস্থলের কতৃত্ব-নিয়ন্ত্রণের এক দম বন্ধ পরিস্থিতির অনুভূতি দেয়। তবে নীল আলোর অধিক ব্যবহারে কখনো কখনো দৃশ্য অস্পষ্ট মনে হয়। এছাড়া রেহানার সারাক্ষণ মাথায় ওড়না প্যাঁচানোর কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না, তার মুসলিম পরিচয়ের জন্য নামাজের দৃশ্যই যথেষ্ট। অবশ্য কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং ধুসর মনস্তত্ত্বে রেহানার জীবনটাই প্যাঁচানো, আমাদের দেশের অনেক নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনের মতোই। বহুমাত্রিক মনস্তত্ত্ব এবং কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য 'রেহানা মরিয়ম নূর' নির্মাণ দলকে অভিনন্দন!
ড. সীনা আকন্দ: বিহেভিয়ার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্যারেন্টিং এডুকেটর, স্থানীয় সরকার, লন্ডন
Comments