রোহিঙ্গা সংকটের ৪ বছর

আগস্ট মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঠিক চার বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সামরিক নেতৃত্বাধীন ক্র্যাকডাউন পরবর্তী সহিংসতার ফলে সাত লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
এর আগে রোহিঙ্গারা বেশ কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারে পদ্ধতিগত ভাবে বৈষম্য, ভোটাধিকার হরণ, নিয়মিত সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া ও নিপীড়ন শিকার হয়ে আসছিল।
আমি যতবার কক্সবাজার যাই, ততবারই রোহিঙ্গা জনগণের অসাধারণ সহিষ্ণুতা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণের উদারতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
২০১৭ সালের আগস্টের ভয়াবহ সহিংসতার চার বছর এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার ঐতিহাসিক মামলা করার প্রায় দুই বছর পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বা সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তার ব্যাপারে সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও এরপর সংঘটিত সহিংসতার পর সহসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরও অনিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কক্সবাজারে মানবিক কার্যক্রম লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এই সংকট ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়েছে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জরুরি খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা পেয়েছে। এই মানবিক সংকট থেকে উত্তরণে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শরণার্থীদের জন্য কোভিড-১৯ টিকার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ পুনরায় প্রশংসনীয় উদারতা দেখিয়েছে।
জীবন রক্ষাকারী মানবিক কার্যক্রমে এমন অগ্রগতি সত্ত্বেও সামগ্রিক পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ও স্থানীয় জনগণের জন্য চ্যালেঞ্জিংই রয়ে গেছে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে ভারী মৌসুমি বৃষ্টির বিধ্বংসী প্রভাব কত বেশি হতে পারে। আমরা আরও দেখেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ড ইতোমধ্যেই শরণার্থীদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তাও ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাল্যবিবাহ এবং নারী ও মেয়ে শিশুদের প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রবণতাও উদ্বেগজনক।
রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের সম্ভাবনা ম্লান হতে দেখে অনেক শরণার্থী বলেছেন, তারা নিরাশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই হতাশ শরণার্থীদের অনেকে মানব পাচারকারীদের প্ররোচনার শিকার হয়ে অনিরাপদ নৌকায় বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রার দিকে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তার উদ্বেগকে ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে।
চলমান রোহিঙ্গা সংকট সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য একটি ট্র্যাজেডি। পৃথিবীর কেউই শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছায় থাকতে চান না। বাস্তুচ্যুত অনেক মানুষকে একসঙ্গে কেউ আশ্রয়ও দিতে চায় না। বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অনেক শরণার্থীর মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ নিজ দেশে ফিরতে চায়।
অন্যান্য দেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক কার্যক্রম সমন্বয় সাধনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। এই সঙ্গে আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা উত্থাপন অব্যাহত রেখেছি। আসিয়ানের নতুন ডায়লগ পার্টনার হিসেবে আমরা আসিয়ানের বিশেষ দূতের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি। আমরা রাখাইনেও রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারে বর্তমান সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে।
যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীরা খুব শিগগির নিজ দেশে ফিরতে পারছে না, তাই স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই, জাতিসংঘের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের অধীনে সম্প্রতি আমরা নতুন অর্থায়ন ঘোষণা করেছি। আমি যেমনটি দেখেছি, রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে নির্মিত সুন্দর আবাসন প্রকল্প কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে জনসংখ্যার চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। আমরা সেখানে জাতিসংঘের উপস্থিতি দেখার কথাও ভাবছি। কিন্তু আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে বিশাল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি থাকবে এবং একই সঙ্গে এই জায়গাটি মানবিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই থেকে যাবে। অতএব, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের একইভাবে সহায়তা করা উচিত।
আজ আমরা রোহিঙ্গা সংকটের পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছি। এই বিশেষ দিনে আমি চারটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করব, যা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণকে এই সংকটের প্রভাব লাঘবে সাহায্য করবে।
প্রথমত, জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ শিথিল করলে এবং রোহিঙ্গা শিবিরে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নীচে নামলে রোহিঙ্গা শিবিরেও বিধিনিষেধ শিথিল করা। এর ফলে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রয়োজনীয় সেবা পৌঁছানো, যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং সুরক্ষা পরিষেবা পুনরায় চালু করা সম্ভব হবে। এতে করে শরণার্থী শিবিরে বর্ষার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মেরামত সম্ভব হবে, লিঙ্গভিত্তিকসহ অন্যান্য সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার সক্ষমতা বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার ওপর নতুন করে মনোযোগ দেওয়া। এতে করে রোহিঙ্গারা শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার, মৌলিক জীবিকা উপার্জনের এবং মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার সুযোগ পাবে। আমি এখানে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের একীভূত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি না। এটা বাংলাদেশ সরকার বা রোহিঙ্গারাও চায় না। কিন্তু বাংলাদেশে থাকাকালীন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হতাশা, অপরাধমূলক প্রবণতা এবং নিরাপত্তাহীনতা থেকে দূরে রাখতে শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ বিশেষভাবে সাহায্য করবে।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা শিবিরে পরিসীমায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নতুন ধরণের পদ্ধতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিষেবা পেতে এবং কোনো বিপদ বা জরুরি অবস্থায় নিরাপদ ভাবে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ দিতে পারে।
চতুর্থত, রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি স্থানীয় জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাজ্য সরকারের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে আমরা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।
আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন রাখাইনে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যেতে চায়। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে না ফেরা পর্যন্ত উপরে উল্লেখিত এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগণকে নিরাপদে রাখবে এবং তাদের সহনশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments