শাবিপ্রবি পরিস্থিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা

শাবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

আমার জীবনে অনেক ভালোবাসার জায়গা আছে, কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে শাহজালাল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। বিআইটিটি (ঢাকা)—যা এখন ডুয়েট, ৯ মাস সেখানে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করার পর শাবিপ্রবিতে যোগদান করি কেমিক্যাল টেকনোলজি (বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং পলিমার বিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন খুবই নতুন। সর্বসাকুল্যে ৩-৪ ভবন ছিল। এখন হয়তো অনেক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পথে এক কিলোমিটারের ওপর একটা রাস্তা ছিল। দুপাশে তখন গাছ লাগানো হয়েছিল। ছবিতে দেখেছি গাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি ভাবতাম—একসময় এর দুপাশে লেকের মতো হবে, বিকেলে ছেলে-মেয়েরা নৌকা নিয়ে সেখানে ঘুরে বেড়াবে। অনেক বছর হয়ে গেল, জানি না হয়েছে কি না। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস পার্কের মতো করে সাজিয়ে রাখা হয়। যেখানে জ্ঞানচর্চা, ভালবাসা এবং তারুণ্যের জয়জয়কার।  

শাবিপ্রবিতে আমার শিক্ষকতার বয়স ছিল ৩ বছরের মতো। এই ৩ বছর আমার জীবনের এক সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। আমরা একঝাঁক তরুণ শিক্ষক প্রাথমিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। তাদের অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। আমার যখন নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সময়, তখন আমি আমার থেকে ৬-৭ বছরের ছোট শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি। আমার সেই ছাত্রদের অনেকের সঙ্গে ফেসবুকে আমার যোগাযোগ আছে। তাদের অনেকেই আজ অত্যন্ত সফল। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে, মালয়েশিয়া, ইউরোপ এবং বাংলাদেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। তাদের অনেকে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। তাদের সাফল্য দেখলে আমার গর্বে বুক ভরে যায় এই ভেবে—একজন ছোটখাটো শিক্ষক হিসেবে আমি কিছুটা হলেও সফল। আমরা তাদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছি।

একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের যত সমস্যা থাকে, তা সাস্টের ছিল। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজনীতিটা অত পোক্ত ছিল না। শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতিও ছিল, সেটা জাতীয় রাজনীতিতে পাত্তা পাওয়ার মতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানটি অনেক তরুণ ভালো শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল; যারা ঢাকার বাইরে যাওয়ার চিন্তা করত না। এ ছাড়া প্রফেসর জাফর ইকবাল তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অন্য একটি মাত্রা দিয়েছিল। ধীরে ধীরে শাবিপ্রবি একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাঁড়াতে শুরু করল। বাংলাদেশে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটি ছিল সঠিকভাবে; ভালো মানের কিছু শিক্ষাবিদ-প্রশাসক এবং নবীন কিছু উদ্যমী শিক্ষকদের নিয়ে। 

এই লেখাটি কারও পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে লেখাও নয় এবং এটা কোনো স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া একটা জনপ্রিয় লেখা নয়। শাবিপ্রবি আবারও ভিসি পদত্যাগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই ধরনের আন্দোলন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেক ভিসি এই ধরনের আন্দোলনের মধ্যে পড়েছেন। আমার এ লেখা প্রকাশ করার আগে হয়তো কোনো একটা সমাধান হয়ে যাবে। কাজেই এটা মাথায় রেখে আমি এই লেখাটিতে সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার কিছু মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। পত্রিকার ঘটনা থেকে যা জানতে পারলাম—এবার ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে ছাত্রী হলের প্রভোস্টের দুর্ব্যবহারের কারণে। কী কারণে দুর্ব্যবহার এবং কী দুর্ব্যবহার সেই বিষয়ে তেমন কিছু পত্রিকায় পাইনি। যতদূর জানলাম, এরপর ছাত্ররা রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে তালা মেরে দিয়েছে। এরপর পুলিশ ডেকে আনার পর ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। আমি ভিডিওটা দেখেছি এবং এখানে আমি মনে করি, ভিসি সম্পূর্ণ অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে তালা দেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। আমি একসময় শাবিপ্রবিতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলাম। প্রফেসর জাফর ইকবাল সভাপতি ছিলেন। এই ক্ষেত্রে জোর প্রয়োগ করে তা খুলে দেওয়া যায়, কিন্তু সেটা হবে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। ২৫ বছর আগেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় এটা দেখেছি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ আসলে এবং যেকোনো ধরনের জোর প্রয়োগ করলে ছাত্র পুলিশ মুখোমুখি হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। এছাড়া পুলিশকে কিছুটা সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। সাউন্ড গ্রেনেড, গুলির মতো বিষয় পুলিশের প্রয়োগ করাটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং সেটা প্রশাসন এবং পুলিশের আরেকটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। ছাত্ররা ক্যাম্পাসে একটা আবেগ নিয়ে চলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাড়া পুলিশের উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে নিজস্ব পুলিশ ফোর্স আছে, ক্যাম্পাসের কিছু সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে।  

এবার আসছি আমরণ অনশনের বিষয়ে। প্রফেসর জাফর ইকবাল এবং ইয়াসমীন ম্যাডাম গিয়ে তাদের অনশন ভাঙিয়েছেন এবং সরকার শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমস্যা সমাধান করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি প্রফেসর ইকবালকে ধন্যবাদ জানাই এই উদ্যোগটি নেওয়ার জন্য। আজকে শাবিপ্রবির যা সুনাম, সেটার সিংহভাগ তার জন্য—সেটা কেউ অস্বীকার করবে না। অথচ আমি শবিপ্রবিতে তাকে কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিগৃহীত হতে দেখেছি। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমরণ অনশন কর্মসূচি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এটা এই পরিস্থিতিতে ছাত্রদের কাছে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন। একজন ভিসির পদত্যাগের ইস্যু এবং পুলিশের আচরণের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখার মতো আন্দোলন এটা নয়। যারা অভিভাবক আছেন তাদের কাছে এটা কত দুঃখজনক সেটা কেবল তারাই উপলব্ধি করেছেন। আগেই বলেছি, ছাত্ররা আবেগ থেকে অনেক কাজ করেন, কিন্তু আলোচনা করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যাবে না সেটা সত্য নয়। ভিসির পদত্যাগ যদি মুখ্য এবং যৌক্তিক হয়, সেটাও আলোচনার মাধ্যমে করা সম্ভব। প্রতীকী অনশন কর্মসূচি দেখেছি, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমরণ অনশন কর্মসূচির মাধ্যমে এটা আরও জটিল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে এটার সমাধান হয়েছে। 
 
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা দলীয় ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষক এবং ভিসি নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি, এটা সবারই জানা। বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ বা আন্দোলন দিয়ে এটা সমাধান করা সম্ভব হবে না। এই বিষয়ে আমি এর আগেও লিখেছি। উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা কখনোই করা সম্ভব নয়। সমাধান যে খুব সহজ তাও নয়, কিন্তু কিছু একটা পদক্ষেপ নিতেই হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। এত বছরের আবর্জনা একদিনে দূর করা সম্ভব নয়, পর্যায়ক্রমে এটা করার জন্য সমাধানে আগাতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান যা পরিস্থিতি, ভিসি পদে কোনো যোগ্য শিক্ষাবিদ সফল হতে পারবে বলে আবার মনে হয় না। এছাড়া ভিসি পদে অনেক যোগ্য শিক্ষাবিদকে নিয়োগ দিলেও পদ নিতে চাইবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিদ-প্রশাসক ধীরে ধীরে তৈরি করা হয়। প্রতিটি শিক্ষক প্রথমে বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করেন, কমিটিগুলোর চেয়ার হন। এরপর এরা  বিভাগের অ্যাসোসিয়েট চেয়ার, চেয়ার, অ্যাসোসিয়েট ডিন, ডিন এরপরে বিভিন্ন প্রভোস্ট (যা বাংলাদেশের প্রো-ভিসির সমকক্ষ) পদে কাজ করেন। চেয়ার, ডিন এবং প্রশাসনিক উচ্চ পদগুলো অত্যন্ত কম্পিটিটিভ, ভালো শিক্ষাবিদ যারা প্রশাসনে কাজ করতে চান তারাই আসেন। ভোটের মাধ্যমে এটা হয় না। কিছু শিক্ষক আছেন যারা প্রচণ্ড সফল শিক্ষাবিদ কিন্তু প্রশাসনে কাজ করতে ইচ্ছুক নন। এভাবে যোগ্য শিক্ষাবিদ-প্রশাসকের একটা পুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৈরি হয়। আমি মনে করি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ধরনের পরিপূর্ণ শিক্ষাবিদ-প্রশাসকের অভাব আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালান বর্তমান পরিস্থিতিতে এত সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রেসিডেন্ট যোগদানের পর প্রতিটি মুখ্য পদে নিজের পছন্দমতো যোগ্য প্রশাসক-শিক্ষাবিদ নিয়োগ দেন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কৌশলগুলো সহজে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

বাংলাদেশ থেকে শত শত শিক্ষার্থী এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং পৃথিবীর  প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছে। একটা উচ্চশিক্ষিত বিশাল পুল তৈরি হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফেরত যেতে চায় এবং যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন গবেষণা হচ্ছে এবং গবেষণা করার তীব্র আগ্রহ ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে আছে। সাম্প্রতিককালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন থেকে এটা বুঝেছি। আমাদের দরকার হচ্ছে প্রাথমিকভাবে আমাদের শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিটা আধুনিকরণ করা এবং এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী সফল গবেষকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ সমস্যা দূর হয়ে যাবে একটা পরিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি এবং শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে পারলে। নিম্ন পর্যায় থেকে এই পরিবর্তন আনতে পারলে, উচ্চ পর্যায়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। এই ধাপটি করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে ছেড়ে দিলে এটা কখনো হবে না। আমি মনে করি বর্তমান সরকারের পক্ষে এখন এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।   

শাবিপ্রবির বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়তো অচিরেই হবে। ছাত্ররা ক্লাসে ফিরে যাবে এটা আমাদের সবারই কাম্য। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই পরিস্থিতির কি শেষ হবে? কিছুদিন পর হয়তো আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে আবারও তালা ঝুলবে, ২৫ বছর আগে একই জিনিসই দেখেছি। আবার বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হবে। ছাত্রদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হবে, আবার সেশন জট হবে। পৃথিবীর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মতো ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতি নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা করা এখন সরকারের গুরু দায়িত্ব। কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এটা করা খুব সম্ভব।

ড. সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এট আরলিংটনের রসায়ন এবং প্রাণ রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

9h ago