১২-১৭ বছর বয়সীদের টিকাদান: একটি বাস্তবতা বিবর্জিত পরিকল্পনা
ভ্যাকসিনের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত না করেই শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষকে টিকা দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনাটি একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সুষ্ঠু সাপ্লাই চেইন অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সুবিধার অভাব, যেটি সমগ্র দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার জন্য আবশ্যক।
এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬৫ বছর ও তার বেশি বয়সীদের জন্য সরকার গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করে। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে বয়সসীমা কমিয়ে ২৫ বছরে আনা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করা হয়।
সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আবারও জানিয়েছেন, যাদের বয়স ১২ অথবা তার চেয়ে বেশি, তাদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগির টিকা দেওয়া হবে।
সরকার প্রায় ১৮ মাস বন্ধ রাখার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে, যার প্রেক্ষাপটে শিশু-কিশোরদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে।
কিন্তু ভ্যাকসিনের সরবরাহ এখনও অনিশ্চিত অবস্থায় আছে এবং ঝুঁকিতে থাকা মানুষসহ দুই কোটিরও বেশি মানুষ নিবন্ধন করার কয়েক সপ্তাহ পরেও প্রথম ডোজের অপেক্ষায় আছেন। এই পরিস্থিতিতে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা চমকপ্রদ মনে হলেও এই মুহূর্তে এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে গতকাল বলেন, 'আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিনের মজুদ নেই। এমনকি ভ্যাকসিনের সরবরাহও নিয়মিত নয়। অনেকেই প্রথম ডোজ নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সবাইকে এখনও টিকা দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ১২ বছর বয়সীদের টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে না।'
টিকাদান বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বে-নজির আরও জানান, কমিটি এখনও ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়ার পক্ষে অভিমত দেয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক জানান, বিশ্বজুড়ে স্কুলগুলো স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের পর খুলেছে, টিকাদানের পরে নয়।
তিনি জানান, যারা টিকা নিয়েছেন, তাদেরকেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
'স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে বেশি নজর দিতে হবে', বলেন মুজাহেরুল।
তিনি আরও জানান, সরকারের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী অধিকতর ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া।
তিনি বলেন, 'আমরা যদি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে না পারি, তাহলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমবে না।'
করোনা টিকা কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, '১৮ বছরের নিচে শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই।'
রোববার দুপুরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে অংশ নিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।
ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মধ্যে বড় আকারের ব্যবধান থাকার কারণে বাংলাদেশের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি বার বার হোঁচট খেয়েছে।
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট হঠাৎ করে ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি প্রায় এক মাসের মতো বন্ধ ছিল।
এ ছাড়াও, সরকার বৈশ্বিক ভ্যাকসিন মৈত্রী কোভ্যাক্সের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভ্যাকসিনের ডোজ পায়নি।
সরকার ৭ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বিশেষ টিকাদান কর্মসূচিও ডোজের অভাবে চালিয়ে যেতে পারেনি।
বাংলাদেশ চীন থেকে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ছয় কোটি ডোজ টিকা কিনেছে। কোভ্যাক্স থেকে সিনোফার্মের আরও ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা আছে। এ ছাড়াও, সেরাম ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে, কিন্তু এ যাবত দেশে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ এসে পৌঁছেছে। গত মার্চে অ্যাস্ট্রাজেনেকার শেষ চালানটি দেশে আসে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা ভালো পরিমাণ ভ্যাকসিন কিনেছি, কিন্তু তার খুব অল্পই আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন মিলিয়ে সর্বমোট তিন কোটি ৯০ লাখ ২৫ হাজার ৫৩০ ডোজ টিকা এসেছে।
প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছেন এবং প্রায় ৮৫ লাখ মানুষ উভয় ডোজ পেয়েছেন।
টিকাদানের মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র পাঁচ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে টিকা দিতে হবে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে তাদের হাতে এক কোটিরও কম ভ্যাকসিনের ডোজ আছে। গত মাসের বিশেষ কর্মসূচির সময়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছিল, যাদেরকে আজ থেকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, 'এই মুহূর্তে ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ ডোজ নেই।'
তিনি জানান, কয়েকটি দেশে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ফাইজারের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।
শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের হাতে ফাইজারের ১০ লাখ ডোজ আছে এবং আরও ৫০ লাখ ডোজ খুব শিগগির আসবে। কিন্তু উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাবে এই ভ্যাকসিনটি সারাদেশে দেওয়া যাবে না।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে তারা ২২টি জেলায় ফাইজারের ভ্যাকসিন দিতে পারবেন, যার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। শুধু এই জেলাগুলোতেই ফাইজার ভ্যাকসিনকে অতি-নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার উপযোগী অবকাঠামো আছে।
২ মার্চে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাবিশ্বের ১৪টি দেশ কমবেশি লকডাউন অবস্থায় ছিল। দেশগুলোর মধ্যে পানামা সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ রেখেছে। এরপরেই আছে এল সালভাদর, বাংলাদেশ ও বলিভিয়া।
৬ এপ্রিল থেকে এল সালভাদরে এবং ৩১ মে থেকে পানামার স্কুলগুলোতে শারীরিক ক্লাস শুরু হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ এখন দীর্ঘতম সময় ধরে স্কুল বন্ধ রাখা দেশের অপ্রীতিকর তকমা পেয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, টিকাদান পরিস্থিতি যেরকমই হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া উচিত।
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments