রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় তেল ও গ্যাসের দাম বাড়বে

ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ চালানোয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে একেরপর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে বিভিন্ন দেশ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাজ্য। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও জাপানসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ চালানোয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে একেরপর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে বিভিন্ন দেশ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাজ্য। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও জাপানসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

ইউক্রেন সংকট ও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বে, দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বাংলাদেশে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—

ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং ২টি অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন? এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন কি না?

বিষয়টি এখানে একটু অন্যভাবে দেখা দরকার। উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোটের (ন্যাটো)  ইউরোপে প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই। ন্যাটো গঠন করা হয়েছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা চিন্তা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে গেল তখন ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা আসলে কী তা জানা দরকার। ন্যাটো মূলত শুরু হয়েছিল ১২টি রাষ্ট্র নিয়ে। সেটি বাড়তে বাড়তে ৩০টি দেশে দাঁড়িয়েছে। এখন ইউক্রেনকেও সদস্য করার এক ধরনের চেষ্টা চলছে। এই জায়গায় রাশিয়া মনে করে, যে চুক্তি তারা করেছিল তার লঙ্ঘন হচ্ছে। সমস্যাটা কিন্তু ওখানেই যে ন্যাটো কতটা সম্প্রসারণ করবে। রাশিয়া জানিয়েছে যে, ন্যাটোর এই কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য না। রাশিয়া মনে করছে ইউক্রেনের যেসব বাসিন্দা রুশ ভাষায় কথা বলে তাদের সহযোগিতা করা দরকার তাই রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের ২টি অঞ্চলের স্বাধীনতা স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়টি আলোচনায় আসলে রাশিয়া সহজেই বলতে পারবে যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে সেজন্য শান্তিরক্ষাকারী হিসেবে আমি সেখানে গেছি। আমি মনে করি না আন্তর্জাতিক আইনে রাশিয়া ও ইউক্রেনেরে সংকট দেখা উচিত। এটা রাজনীতির মধ্যে খোঁজা উচিত বলে আমি মনে করি। পশ্চিমারা যদি বলেন যে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না বা ইউক্রেন যদি বলে যে তারা ন্যাটোর সদস্য হবে না তাহলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আইনে ইউক্রেন রাশিয়া যে সংকট তা কখনো সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না। এটা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করা উচিত।

রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে এর প্রভাব কী পড়বে বলে আপনি মনে করেন?

আমার মনে হয় না এর ফলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে। এখন পর্যন্ত যেসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেগুলো অনেকটা ঠুনকো। তারা বারবার বলছে যে নিষেধাজ্ঞা বাড়াবে। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ার ওপরও তেমন একটা প্রভাব ফেলা যাবে না। কারণ রাশিয়া আগে থেকেই জানে তারা এক ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে। আর এ কারণেই রাশিয়া চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছে। সমস্যার সমাধান কিন্তু ইউরোপিয়ানদের কাছে। তবে আমারে মনে হয় না তারা চাইবে যে তাদের ঘরের মধ্যে একটা যুদ্ধ হোক। যেখানে আবার আমেরিকা জড়িত। বড় আকারে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তেমন একটা লাভ হবে না বলে আমি মনে করি। আর সেটা আমেরিকা ভালো করেই জানে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। তবে নিষেধাজ্ঞা যদি আরও জোরালো করা হয় সেক্ষেত্রে এখনো বলা যাচ্ছে না।

রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সমস্যা হবে। তবে বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ হয়ে যাক এটা কেউ চাইবে না। রাশিয়া কিন্তু বুদ্ধি করেই দুটি অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা এটাও বলেছে যে ইউক্রেন তাদের কথা না শুনলে তারা আরও সমস্যা করবে। দীর্ঘকালীন সংকট তৈরি হলে আমেরিকারও ক্ষতি হবে। আমেরিকাও কিন্তু সেটি চাইবে না। যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে করে বিশ্বে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে আরও বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে, সাপলাই লাইন কেটে গেলে তখন অন্যভাবে চিন্তা করা যাবে।

এক্ষেত্রে ন্যাটোর ভূমিকা কী হবে?

রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে ন্যাটো লাফ দিয়ে পড়বে এবং যুদ্ধে জড়াবে বিষয়টি এমন নয়। কারণ ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ন্যাটো বা জার্মানি চাইবে না যে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হয়ে একটা ঝামেলা তৈরি হোক। কারণ জার্মানির প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর করে রাশিয়ার ওপর।  ইউরোপের একাধিক দেশ রাশিয়ার গ্যাস ও পেট্রোলের ওপর নির্ভর করে।  সেই জায়গায় ইউরোপ কোনো লড়াই চাইবে না। কারণ এখানে তাদের কোনো লাভ নেই। আমি মনে করি না যে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পাবে। বড় আকারে কোনো যুদ্ধ হবে বলে আমি মনে করি না। এই যুদ্ধ পরিস্থিতি রাখতে পারলে বাইডেন প্রশাসনের লাভ হবে। কারণ সামনে আমেরিকার অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন। বাইডেনের জনপ্রিয়তা তেমন একটা ভালো না এখন। তাছাড়া এই যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখাতে পারলে আমেরিকার লাভ হবে। কারণ আমেরিকা তখন দেখাবে যে ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা আছে। ন্যাটোর কারণেই কিন্তু জার্মানিসহ ইউরোপে বিভিন্ন দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাটি আছে।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের ওপর কেমন প্রভাবে পড়তে পারে?

তেল ও গ্যাসের দাম বাড়বে। এর প্রভাব প্রথমে কিন্তু ইউরোপ অনুভব করবে। আমেরিকাও এই বিষয়টি ভালোভাবে জানে। আমেরিকার জনগণও এটা অনুভব করবে। মানুষের কেনাকাটা কমে যাবে। ইউরোপ সেটা কতটা সহ্য করবে সেটা দেখা দরকার। রাশিয়া বলেই দিয়েছে তারা দাম বাড়িয়ে দেবে। নিষেধাজ্ঞা বাড়তে থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে।

এই সংকটের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

দক্ষিণ এশিয়ায় এর ফলে কোনো প্রভাব পড়ার কথা না। কারণ ভারত ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে তারা এর মধ্যে থাকবে না। ভারত ইউরোপকে বলেছে, আমরা যখন চীনের সঙ্গে সমস্যায় ছিলাম তখন আপনারা কোথায় ছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বড় ধরনের সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে সামরিক সম্পর্ক। আমি মনে করি না এই নিষেধাজ্ঞায় ভারত উৎসাহিত হবে বা যোগ দেবে। রাশিয়ায় থেকে ভারত যাতে অস্ত্র না কেন এমন একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু ভারত তাতে রাজী হয়নি। তারা অস্ত্র কিনেছে। আমার মনে হয় না আমেরিকা এখন সেই অবস্থায় আছে যে, তারা যা বলবে ভারত বা অন্যান্য রাষ্ট্র তা শুনবে।

সংকটের ফলে বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

ইউক্রেনের সঙ্গে আমাদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আমারা তো সবসময় বলেই আসছি যে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবো, কারো সঙ্গে বৈরিতা না। আমরা এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবো না। এটা ইউরোপ আর আমেরিকার বিষয় তারাই সমাধান করবে। এখানে বড় আকারে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরালো হলে তা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি? 

আমরা কখনোই রূপপুর প্রকল্প বন্ধ করবো না। এখানে আমেরিকা তেমন একটা সুবিধা করতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকান ব্যবসায়ীদের কিন্তু বড় একটা স্বার্থ জড়িত আছে। আমেরিকা কোনো সমস্যা তৈরি করতে চাইলে এর প্রভাব কিন্তু আমেরিকান ব্যবসায়ীদের উপরেও গিয়ে পড়বে। কারণ তারা বাংলাদেশ থেকে স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনে আমেরিকায় গিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। ব্যবসায়ীরা তখন প্রশাসনকে বলবে আপনাদের সমস্যার কারণে কেন আমাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে? আমার মনে হয় না রূপপুরে সমস্যা হবে সেই পর্যায়ে এই সংকট যাবে। যদি যায় তবে কিন্তু আমেরিকা ভুল করবে। বিষয়টি তেমন পর্যায়ে যাবে না।

এই সংকট কীভাবে সমাধান হতে পারে?

আমেরিকা দেখাতে চেষ্টা করবে যে তাদের জয় হয়েছে, রাশিয়া সরে গেছে। তবে সেটাও হবে না। কারণ পুতিন দেখিয়ে দিয়েছে যে সেই রাশিয়া আর নেই। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন পর্যন্ত দেখতে হবে। আমি মনে করি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ চাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ইউক্রেনের নিজস্ব নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। তাদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিকভাবে অনেক ঘাটতি আছে। আমেরিকার ওপর নির্ভর করে ইউক্রেন উন্নয়ন করবে এটা ভুল চিন্তা। ইউক্রেনকে প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে অবশ্যই ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখন প্রশ্ন আছে। তাই ন্যাটোর সদস্যপদ না চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে সমস্যারও সমাধান হবে আর ইউক্রেনেরও উপকার হবে।

    

Comments

The Daily Star  | English

Mercury hits 42.7°C in Chuadanga, season's highest

Chuadanga today recorded the highest temperature of this season at 42.7 degree Celsius

17m ago