স্যার বলার সংস্কৃতি

লেখার বিষয়বস্তু হয়তো শিরোনাম পড়লেই বোঝা যায়। বিষয়ে সরাসরি যাওয়ার আগে প্রথমে একটু ভূমিকা দেই। আমেরিকাতে আমি প্রথমে পড়তে আসি ফ্লোরিডার মায়ামি শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাস্টার্স করতে। আমার মতো অন্য সব বাংলাদেশির কাছে তখন আমেরিকায় পড়াশোনার অভিজ্ঞতা হচ্ছে—হোটেল গ্রেভার ইন। নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হুমায়ূন আহমেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বইটি।

লেখার বিষয়বস্তু হয়তো শিরোনাম পড়লেই বোঝা যায়। বিষয়ে সরাসরি যাওয়ার আগে প্রথমে একটু ভূমিকা দেই। আমেরিকাতে আমি প্রথমে পড়তে আসি ফ্লোরিডার মায়ামি শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাস্টার্স করতে। আমার মতো অন্য সব বাংলাদেশির কাছে তখন আমেরিকায় পড়াশোনার অভিজ্ঞতা হচ্ছে—হোটেল গ্রেভার ইন। নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হুমায়ূন আহমেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বইটি।

নর্থ ডাকোটা নামক তীব্র শীতের এই স্টেট এবং স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি বাংলাদেশিদের চিনিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমেরিকায় এসে প্রথমে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীর মতো আমি সব অধ্যাপকদের স্যার বলে ডাকা শুরু করলাম। সব অধ্যাপকই আমাকে বলেছে, স্যার বলে ডাকার দরকার নেই। নামের শেষাংশ ধরে ড. অমুক বলে সম্বোধন করলেই হবে। আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বিভাগের সিনিয়র থেকে জুনিয়র সব শিক্ষকদের ড. অমুক বলে ডাকতে। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ায় আমাকে সপ্তাহে দুদিন ল্যাবের ক্লাস নিতে হতো। আমার আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা আমাকে আমার নামের প্রথম অংশ ধরে ডেকেছে। বুঝলাম এটাই এখানকার চল।

মাস্টার্স শেষ করে আমি চলে যাই পিএইচডি করতে, ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাকে ফ্লোরিডার মায়ামি থেকে ওয়াশিংটনে প্লেনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেল, যাতে আমি তাদের পিএইচডি প্রোগ্রাম সম্পর্কে আরও ভালো করে জানি। সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের যেই দিন ভিজিট করার কথা তার আগের দিন আমার সান ডিয়েগোতে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্সে একটি রিসার্চ টক দেওয়ার কথা। মাস্টার্স ছাত্র হিসেবে এটা আমার কাছে বিরাট সৌভাগ্য। কিন্তু এটা ওদেরকে জানানোর পর আমাকে মায়ামি থেকে সান ডিয়েগোর ফ্লাইট এবং পরদিন রাতে ওয়াশিংটন স্টেটে আসার ফেরার টিকেটও করে দিল। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলোতে সঠিক শিক্ষার্থীদের নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে। কারণ, অধ্যাপকদের গবেষণাগুলো চলে এই শিক্ষার্থী এবং পোস্টডকদের দিয়ে। পিএইচডিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে। আমি বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিট করেছিলাম এভাবে। যা হোক, ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম আমার দেখা হয় বিভাগের চেয়ার-এর সঙ্গে। তার গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন লিজেন্ড। বর্তমানে অবসরে আছেন। আমি যখন আমার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাকে ড. অমুক বলে সম্বোধন করলাম, তিনি বললেন, ‘আমাকে তুমি প্রথম নাম ধরে ডাকবে।’

এতো সিনিয়র একজন অধ্যাপককে আমি প্রথম নাম ধরে ডাকব? আমি ইতস্তত করলাম। তিনি বললেন, ‘এটাই এখানকার চল।’ এরপর বিভাগের নতুন শিক্ষার্থীদের পিকনিকে যাব। আমার তখন গাড়ি নেই। আমাকে সেক্রেটারি জানাল, আমাকে একজন তুলে নেবে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি গাড়ি নিয়ে আসলেন আমার বিভাগের চেয়ার। আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি উঠো। আমি আস্তে করে সামনে তার পাশের সিটে উঠে পড়লাম। অথচ, আমার পরিচিত বাংলাদেশি এক পরিবারের সংসার ভেঙে গিয়েছিল শুধু সামনের সিটে শ্বশুর উঠবে না নিজের বাপ উঠবে এই নিয়ে দ্বন্দ্বে। এরপর আমি পোস্টডকে গেছি প্যাসিফিক নর্থ ওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথে (এনআইএইচ)। প্রথমটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয়টিও সরাসরি ফেডারেল সরকারের প্রতিষ্ঠান। এখানে আমার বস থেকে শুরু করে ইন্সটিউটের ডিরেক্টরকে আমরা নাম ধরে ডাকতাম। আমার মতো একজন রিসার্চ ফেলো একজন ডিরেক্টরকে প্রথম নাম ধরে ডাকে। যদিও দেখা হলে সম্মান করে অনেক সময় ড. অমুক বলেও সম্বোধন করতাম।

টেক্সাসে শিক্ষকতা করতে এসে দেখেছি, পিএইচডি শিক্ষার্থীরা আমাকে শেষ নাম ধরেই ডাকে। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরাও আমাকে একই নামে অথবা প্রফেসর বলে ডাকে। অ্যাকাডেমিয়াতে শিক্ষক যত সিনিয়র বা জুনিয়রই হোক না কেন, তারা সবসময় তাদের সহকর্মীদেরকে প্রথম নামে ডাকে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা প্রথম পরিচয় হলে, সম্মান করে অনেক সময় ড. অমুক বলে ডাকে। পরে প্রথম নামে ডাকা শুরু করে। আমার কয়েকজন বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী আছে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকাটা চল। আমার ওই শিক্ষার্থীরাও আমাকে প্রায়ই স্যার বলে ডাকে, তাদের স্বভাব সুলভ অভ্যাসের কারণে।

পুরো ভূমিকাটা লেখার কারণ হয়তো এখন অনুমান করা যায়। বাংলাদেশে একটি কমন বিষয় হচ্ছে, সিনিয়রদের ‘বস’ হয়ে যাওয়া এবং এমনকি অন্য পেশার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরকারি আমলাদের ‘স্যার’ বলা নিয়ে সমস্যা। সাধারণ জনগণের কথা তো বাদই দিলাম। মূল সমস্যা এই স্যার বলার সংস্কৃতি। পত্রিকায় পড়লাম, ভারতে একজন আমলা প্রতি মিনিটে ১৬ বার স্যার বলেন। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে সহকর্মীরা নিজেদেরকে সাধারণত প্রথম নামে ডাকে। আমাদের বাঙালি কালচারে একটু সম্মানের ব্যাপার আছে। আমরা সিনিয়রদের ভাই বলে ডাকি এবং বসদের স্যার বলি। কিন্তু মি. অমুক বলে সম্মানের সঙ্গে যে কাউকেই সহজেই ডাকা যায়, এটা মানতে রাজি নই। নিজস্ব অফিসের সহকর্মীদের প্রথম নামে ভাই বলে ডাকতেও কোনো অসুবিধা দেখি না। এতে কাজের পরিবেশ আরও যথার্থ হবে বলে আমি মনে করি। অনেকে ভাবেন এই স্যার বলার সংস্কৃতি না থাকলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাবে। একমাত্র সামরিক বাহিনী ছাড়া কোনো উন্নত বিশ্বে এই সংস্কৃতি নেই। আমেরিকাতে সাংবাদিকরা অহরহ মি. প্রেসিডেন্ট এবং মি. সেক্রেটারি বলে প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীকে ডাকছে। এতে করে এতো বড় মানুষের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে তো দেখিনি। আমাদের সংস্কৃতিতে শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্মান করার ব্যাপার আছে। আমরা শিক্ষকের কাছে শিখি। কিন্তু যে আপনার ট্যাক্সের টাকায় বেতন পায় এবং যে অফিস জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য বানানো হয়েছে, সেখানে স্যার ডাকার এই সংস্কৃতি পরিহার করা উচিত। আমেরিকাতে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড জবগুলোর কর্মকর্তারা জনগণকে সম্মান করে স্যার বলে ডাকে। রাস্তায় পুলিশ কারও গাড়ি থামালেও অনেকে স্যার বলে কাগজ দেখাতে অনুরোধ করে।

আমি মনে করি না এই স্যার বলার সংস্কৃতি দেশ থেকে একদিনে চলে যাবে। তবে একটা কার্যকরী কাজের পরিবেশ তৈরির জন্য এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা যত তাড়াতাড়ি বিদায় করা যায় ততই জাতির জন্য মঙ্গল।

সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এট আরলিংটনের রসায়ন এবং প্রাণ রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

53m ago