এক সাহসী মায়ের অসামান্য কীর্তি

আমরা এক মায়ের দুঃসাহসিকতার কাহিনী শুনে অভিভূত হয়েছি। গতকাল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি তার মেয়েকে উদ্ধার করার জন্যে স্বেচ্ছায় ভারতে পাচার হয়েছিলেন। একই পাচারকারী দলটি তার ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে এবং বিহারের একটি যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। সেই মায়ের জন্যে এটি অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ ছিল। একইসঙ্গে আমরা এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা না করে পারছি না, কেন তাকে এরকম বেপরোয়া উদ্যোগ নিতে হলো? কেন তাকে তার নিজের ও মেয়ের জন্যে এত বড় ঝুঁকি নিতে হলো? বিষয়টা কি এরকম ছিল যে, তিনি তার সন্তানকে উদ্ধার করার জন্যে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথোপযুক্ত সহায়তা পাননি এবং সে কারণেই বাধ্য হয়ে এরকম ঝুঁকি নিয়েছেন?
মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্যে যে পরিমাণ ভালবাসা বুকে ধারণ করেন এবং যতটুকু আত্মত্যাগের মানসিকতা রাখেন, তার কোনো তুলনা নেই। এ ঘটনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে। তবে, নিশ্চিতভাবেই তিনি কী পরিমাণ বিপদের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন এবং এক্ষেত্রে পাচারকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং তার মেয়েকে যৌনপল্লীতে থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ ছিল, সে বিষয়েও তিনি অবগত ছিলেন। তবুও তিনি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যান। পাচারকারীদের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখেন, তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যান এবং যখন তারা তাকে দিল্লিতে পাচার করে দেয়, সেখান থেকে তিনি বিহারে গিয়ে অবশেষে স্থানীয়দের সহায়তায় মেয়েকে যৌনপল্লী থেকে উদ্ধার করেন।
নিশ্চিতভাবেই তিনি অন্যান্য বিকল্পের কথা ভেবেছেন এবং চেষ্টা করেছেন। নিজের জন্যে না হলেও তার মেয়েকে পাচারকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে তিনি এটি করেছেন। খুব সম্ভবত যখন অন্যসব বিকল্প ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তখনই তিনি শেষ ভরসা হিসেবে নিজে পাচার হয়েছেন। কিন্তু, কেন তার অন্যান্য প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হলো? কেন তিনি নিজে যেভাবে তার কন্যাকে দয়ামায়াহীন অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনলেন, সে একই কাজটি করার জন্যে কর্তৃপক্ষের ওপর ভরসা রাখতে পারলেন না?
এই মায়ের কাহিনীটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর র্যাব পাচারকারী দলের তিন সদস্যকে ঢাকা ও মাদারীপুর থেকে সোমবার গ্রেপ্তার করে। মজার বিষয় হলো, ওই তিন ব্যক্তিকে আগেও একই অপরাধের জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ বিষয়টি তাদেরকে চিহ্নিত করা ও গ্রেপ্তারের বিষয়টিকে সহজ করার কথা। তাহলে কেন কর্তৃপক্ষ এর আগে এই কাজটি করতে ব্যর্থ হলো এবং মেয়েটির মাকে এত কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হলো? কেন এই অপরাধীগুলো জেলখানার বাইরে থেকে সেই একই ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে থাকছে, যার জন্যে তাদেরকে আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? নিশ্চিতভাবেই মানবপাচারের অপরাধটি আরও দীর্ঘ সময় ধরে তাদেরকে জেলখানায় রাখার জন্যে যথেষ্ট গুরুতর? তাহলে কোথায় এবং কীভাবে রাষ্ট্রের কার্যপ্রণালী ব্যর্থ হলো?
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজারো মানুষ পাচার হচ্ছে এবং তাদেরকে এত ভয়ংকর সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেটা সারাজীবনের জন্যে তাদের মনে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। রাষ্ট্রের নিশ্চয়ই এমন কোনো প্রক্রিয়া রয়েছে যাতে পাচারকারীরা মানুষকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ফেলতে না পারে এবং সঙ্গে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা আছে যাতে আন্তর্জাতিক পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের দ্রুতই উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়। কেননা, যত সময় অতিবাহিত হতে থাকে, ততটাই কমে আসতে থাকে উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং সরকারের জন্যে এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে কেন সন্তানের মা সবকিছু জানা সত্ত্বেও নিজেকে এরকম বিপদের মুখে ঠেলে দিলো এবং কেন রাষ্ট্র তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাপ্য সহায়তাটুকু দিতে পারল না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments