বিদেশে বিনিয়োগের খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে সরকার

বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ বাড়াতে সরকার খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ হিসেবে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি কিংবা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পারবে। 

বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ বাড়াতে সরকার খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ হিসেবে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি কিংবা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পারবে। 

খসড়া অনুযায়ী, রপ্তানিকারকরা বিদেশের মাটিতে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্য গত ৫ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করতে পারবেন।

উদ্যোক্তারা রপ্তানি থেকে অর্জিত আয়ের একটি অংশ এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) অ্যাকাউন্টে রেখে থাকেন। বিদেশে বিনিয়োগের যোগ্যতা অর্জনের জন্য রপ্তানিকারকদের তাদের ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ স্থিতি রাখতে হবে।

অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৈরি করা খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, রপ্তানিকারকদের হাতে আরেকটি বিকল্প আছে। তারা চাইলে সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন।

বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ এর আওতায় তৈরি করা নীতিমালা এমন এক সময় আসছে যখন বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কলেবর বাড়ানোর জন্য বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে দেশের বাইরে সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা অফিস খোলার অনুমতি দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠান ভারত, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফার্মাসিউটিকাল ও খেজুরের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার অনুমতি পেয়েছে।

এর আগে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০টি প্রতিষ্ঠানকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ায় সহযোগী প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দেয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, তারা নতুন বিধিমালা তৈরি করেছেন যাতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পান। সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব রপ্তানিকারীর ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ স্থিতি আছে, তারা অন্যান্য দেশে বিনিয়োগের আবেদন জানাতে পারবেন। আবেদনকারীকে আর্থিকভাবে সচ্ছল অথবা ৫ বছর কার্যকর থাকতে হবে। এছাড়াও, আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসনের সনদ ও আমদানি দায় নিষ্পত্তির সনদ জমা দিতে হবে।

সংস্থাগুলোকে কোনো খেলাপি ঋণ বা অসমন্বিত পুনর্গঠিত বৃহৎ ঋণ নেই এবং শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর অপরিশোধিত নেই, এই মর্মে সনদ দিতে হবে। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, তাদেরকে কমপক্ষে এ ধরনের দুটি কাগজ জমা দিতে হবে।

বিনিয়োগ গন্তব্য নির্বাচন নিয়েও কিছু শর্তও প্রযোজ্য হবে। খসড়ায় বলা হয়েছে, যেসব দেশে মুনাফা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই, শুধুমাত্র সেসব দেশেই বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হবে।

যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এছাড়াও, যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক পুঁজি-বিনিয়োগ, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ চুক্তি আছে, সেগুলোও প্রাধান্য পাবে।

যেসব দেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রকের থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেসব দেশে বিনিয়োগের কোনো প্রস্তাব অনুমোদন করা হবে না।

প্যারিসভিত্তিক ফাইনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স যেসব দেশকে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেসব দেশেও কোনো ধরনের বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে না।

একইভাবে, যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, সেখানেও বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হবে না।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশে বিনিয়োগের অর্থ সরাসরি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। তবে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অর্থ সরাসরি শেয়ার হস্তান্তরকারীর অনুকূলে পাঠাতে হবে। যদি কোনো কারণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ সম্ভব না হয়, তাহলে দেরি না করে অর্থ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া আয়, লভ্যাংশ, মুনাফা অথবা শেয়ার বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া পুনর্বিনিয়োগ করা যাবে না।

অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্তৃক স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি অবমাননাকর আচরণ ও মন্তব্য এবং বর্ণবাদী আচরণ ও কার্যকলাপের বিষয়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে শূন্য সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশি আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান ইক্যুইটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের বাইরের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ মালিকানা বা পরিচালনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এরকম সংখ্যক শেয়ারের মালিক হতে হবে। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদেরকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ ব্যাংক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি ব্যবসায় পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, যেখানে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ঘটনা যা প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ ও হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এরকম সকল বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হবে। তাদেরকে ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত ডিলার শাখার মাধ্যমে আবেদন জানাতে হবে।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে কোনো সময় বিদেশে স্থাপিত সহযোগী প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পারবে এবং বিনিয়োগকারীদের সেই পরিদর্শনের খরচ বহন করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, পরিদর্শনের খরচ বিনিয়োগকারীরা বহন করলে তাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

তিনি বলেন, 'এ ধরনের ব্যবস্থা উপযুক্ত মূল্যায়নের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।'

তবে তিনি জানান, বিদেশে যাওয়া ব্যয়বহুল, তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিদেশে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে একটি সেবা চার্জ আদায় করে সেটি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখতে পারে। পরে মূল্যায়নের সময় এই অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার করা হবে।

বিনিয়োগকারীদের বিদেশে স্থাপিত সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণ, বার্ষিক শেয়ার মূলধনের সংক্ষিপ্তসার এবং প্রযোজ্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত অংশীদারদের (শেয়ারহোল্ডার) তালিকা জমা দিতে হবে।

বিনিয়োগকৃত দেশের যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধির বিবরণী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের পরিবর্তনের তথ্য প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের মূল প্রতিষ্ঠান এবং সমন্বিত প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে।

এছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের তাদের ব্যবসার প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিবরণ জমা দিতে হবে, যেখানে বর্তমান এবং নতুন পণ্য, ব্যবসায়িক টার্নওভার, মুনাফার মার্জিন, উৎপাদন খরচ এবং বাজারের অংশীদারিত্ব ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করতে হবে।

খসড়া নীতিমালা বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের অন্যান্য বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া শেয়ার বিক্রি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগের অপব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করা হলে এটি অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই অপরাধে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী, পরিচালক, প্রধান নির্বাহী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তারা দায়ী হবেন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ এর সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Road Surface Melting: Bargain bitumen failing to bear extreme heat

As the country is baking in heatwave, road surfaces in several districts have melted due to what experts say is the use of bitumen that cannot withstand this extreme heat.

3h ago