করোনাকালে জনপ্রিয় কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কন্টাক্টলেস বা পিনবিহীন ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন বাড়াচ্ছে। এ ধরনের ট্যাপ অ্যান্ড পে প্রযুক্তি ভোক্তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ডিজিটাল পেমেন্ট করতে সহায়তা করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কন্টাক্টলেস বা পিনবিহীন ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন বাড়াচ্ছে। এ ধরনের ট্যাপ অ্যান্ড পে প্রযুক্তি ভোক্তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ডিজিটাল পেমেন্ট করতে সহায়তা করছে।

২০১৮ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৬টিরও বেশি ব্যাংক কন্টাক্টলেস কার্ড চালু করেছে এবং করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে এই ধরনের কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে।

বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে ৭০ শতাংশ করে বেড়েছে এর ব্যবহার।

কন্টাক্টলেস লেনদেন প্রযুক্তি সম্বলিত ৪২ হাজার পয়েন্ট অফ সেল (পিওএস) টার্মিনাল রয়েছে দেশে।

বাংলাদেশে মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কন্টাক্টলেস কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। এটিই পেমেন্টের ভবিষ্যৎ, কারণ এতে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।'

কন্টাক্টলেস পেমেন্ট সুবিধা সম্পন্ন পিওএস টার্মিনালের কাছে কার্ড এনে 'ট্যাপ' করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে টার্মিনালে হাত দেওয়া, কার্ড সোয়াইপ করা বা যন্ত্রে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন হয় না।

যে কয়টি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে আগে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি চালু করেছে, তাদের মধ্যে সিটি ব্যাংক অন্যতম।

ব্যাংকটি ভোক্তাদের জন্য বেশ কিছু কন্টাক্টলেস কার্ড চালু করেছে, যেমন আমেরিকান এক্সপ্রেস প্লাটিনাম কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস সিটি আলো কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস বিমান কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস আগোরা কার্ড এবং ভিসা প্লাটিনাম কার্ড।

ব্যাংকটি অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করছে এবং তাদের প্রায় ২৭ হাজার পিওএস মেশিন আছে যেগুলো কনটাক্টলেস লেনদেনে সক্ষম।

ঢাকা ব্যাংক ২০১৮ সালে এই সুবিধাটি চালু করে। তাদের সব ভিসা ও মাস্টারকার্ড পণ্য কন্টাক্টলেস লেনদেন সুবিধাযুক্ত।

ঢাকা ব্যাংকের হেড অফ রিটেল বিজনেস এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'কন্টাক্টলেস পেমেন্ট ব্যবস্থা নগদ টাকা-বিহীন সমাজের পথ দেখাচ্ছে। সারা বিশ্বে এটি পেমেন্টের একটি নিরাপদ প্রক্রিয়া হিসেবে জনপ্রিয়।'

তিনি আরও বলেন, 'করোনাভাইরাস নগদ অর্থের পরিবর্তে কার্ড ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।'

জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ঢাকা ব্যাংকের কন্টাক্টলেস কার্ডের মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ যথাক্রমে ১৬২ ও ১০৩ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশে শুধুমাত্র ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কন্টাক্টলেস লেনদেনের অনুমোদন রয়েছে। তবে এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ডেবিট ও প্রিপেইড কার্ডেও এই সুবিধা চালু করা প্রয়োজন, যাতে আরও বেশি মানুষ এই সেবা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।

২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কন্টাক্টলেস কার্ডের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমাকে ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার করে।

প্রথম সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসিক ব্যাংক এ বছরের ডিসেম্বরে একটি ডুয়াল কারেন্সি কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড বাজারে ছেড়েছে।

ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) ভিসা ও মাস্টারকার্ড ব্র্যান্ডের কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড বাজারে ছেড়েছে। তাদের ১ লাখ ৯০ হাজার ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে ২০ শতাংশ কন্টাক্টলেস।

ইবিএলের ৫ হাজার পিওএস টার্মিনালে কন্টাক্টলেস লেনদেন সুবিধা রয়েছে।

ইবিএলের হেড অফ ডিজিটাল ফাইনান্স সার্ভিস আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'আমরা সব পণ্যে কন্টাক্টলেস লেনদেন সুবিধা রাখিনি, কারণ আগে আমাদের সব পিওএস টার্মিনালে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ছিল না।'

তবে ব্যাংকটি সব নতুন ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে এই সুবিধা দিচ্ছে। কন্টাক্টলেস কার্ডের উৎপাদন খরচ প্রথাগত কার্ডের চেয়ে দেড় গুণ বেশি।

উন্নত বিশ্বে কন্টাক্টলেস কার্ড ব্যবহার করে খুব সহজে বাস ও ট্রেনের টিকেট কেনা যায়।

আহসান বলেন, 'ঢাকায় মেট্রোরেল সুবিধা চালু হলে এ ধরনের কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে।'

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যেহেতু কোনো ব্যাংকই কন্টাক্টলেস কার্ড ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো প্রচার চালায়নি, বিক্রেতারা এর ব্যবহার সম্পর্কে তেমন জানেন না। এছাড়াও এই সুবিধাসহ পিওএস টার্মিনালের সংখ্যা কম থাকাও এক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা।

২০২০ সালের আগস্টে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড চালু করে। এক্ষেত্রে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের সময়ে কফির দোকানের বিল দেওয়া, গাড়ীতে গ্যাস ভরানো বা টিকেট কেনার মত ছোট লেনদেনের ক্ষেত্রে ট্যাপ-টু-পে সুবিধাকে জনপ্রিয় করা।

ব্যাংকের ১ লাখ ২৫ হাজার ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে ৩০ শতাংশে এই সুবিধা রয়েছে। ডেবিট কার্ডসহ সব নতুন কার্ডে এই সুবিধা থাকছে।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখনও অনুমোদন না দেওয়ায় ডেবিট কার্ডের ক্ষেত্রে এই সুবিধাটি বন্ধ রাখা হয়েছে।

বহুজাতিক ব্যাংকটির হেড অফ কনজ্যুমার, প্রাইভেট অ্যান্ড বিজনেস ব্যাংকিং সাব্বির আহমেদ বলেন, 'আমাদের গ্রাহক সংখ্যা ও তাদের চাহিদা বাড়ছে এবং আমরা তাদের অভিনব ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ব মানের সেবা দিতে সংকল্পবদ্ধ।'

২৮ জুলাই, ২০১৮ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে কন্টাক্টলেস কার্ড চালু করে। তখন থেকে ব্যাংকের লেনদেনে প্রতি বছর গড়ে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

ইউসিবির হেড অফ কার্ডস নেহাল এ হুদা বলেন, 'এটি একটি নতুন ধারণা এবং ভোক্তারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত নন। কন্টাক্টলেস পেমেন্টকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় বাঁধা।'

ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ কার্ড এই প্রযুক্তি সহায়ক, যার পরিমাণ সংখ্যায় ৩৫ হাজার।

বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রেতাদের কাছে তাদের ১২ হাজার পিওএস যন্ত্র রয়েছে, যার সবগুলোতেই কন্টাক্টলেস লেনদেন করা যায়।

ব্যাংকাররা জানান, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের জন্য ট্যাপ অ্যান্ড পে প্রক্রিয়া অনুসরণকে বাধ্যতামূলক করে দেয়, তাহলে কন্টাক্টলেস পেমেন্টের পরিমাণ অনেক বাড়বে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্র্যাক ব্যাংক কন্টাক্টলেস ভিসা ক্রেডিট কার্ড চালু করে। ব্যাংকের হেড অফ রিটেল ব্যাংকিং মহিউল ইসলাম জানান, তাদের ৯ হাজার পিওএস টার্মিনালকে পর্যায়ক্রমে কন্টাক্টলেস প্রযুক্তিতে রূপান্তরের কাজ চলছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে এ যাবত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) প্রায় ৪০ হাজার কন্টাক্টলেস কার্ড দিয়েছে ভোক্তাদের।

এমটিবির হেড অফ এসএমই অ্যান্ড রিটেল ব্যাংকিং শাফকাত হোসেন বলেন, তাদের ৩ হাজার ৫০০ পিএওএস টার্মিনালের মধ্যে এক হাজার ৩০০টিতে কন্টাক্টলেস কার্ড ব্যবহার করা যায়।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মাস্টারকার্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে লংকাবাংলা কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড চালু করে। পরের মাসে কন্টাক্টলেস ভিসা কার্ডও চালু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।

লংকাবাংলার হেড অফ রিটেল বিজনেস খুরশেদ আলম বলেন, তাদের ১ লাখ ৪৫ হাজার ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে ৮৫ শতাংশ কার্ডে কন্টাক্টলেস লেনদেন সুবিধা আছে।

মাস্টারকার্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১০০টিরও বেশি দেশে প্রথাগত ক্রেডিট কার্ড ভিত্তিক লেনদেনের তুলনায় কন্টাক্টলেস লেনদেনের পরিমাণ অন্তত ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

10h ago