বড় হচ্ছে বাজার, বছরে ৪০০ কোটি টাকার কেক-পেস্ট্রি বিক্রি

সে হোক উপলক্ষ কিংবা প্রয়োজন, কেক যেন এক টুকরো ভালোবাসা। আগে খাবার হিসেবে কেকের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা অনেকখানি নগর সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সময় ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই চিত্র পাল্টে গেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে মিষ্টি জাতীয় খাবারের দিকে বাড়তি ঝোঁক তৈরি হওয়ার কারণে দেশে কেকের বিক্রিও দ্রুত গতিতে বাড়ছে।

বাংলাদেশে কেকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কুপারসের বিপণন প্রধান আমিনুল ইসলাম রাশেদ যেমন বলছিলেন, 'দেশে কেক ও পেস্ট্রির বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতে ছোট, মাঝারি ও বড় কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। এর বাইরে ঘরে তৈরি কেক ও কেকজাতীয় পণ্যের চাহিদা ও বিক্রিও বেড়েছে বহুগুণ।'

বাংলাদেশে কেক তৈরির ইতিহাস অন্তত এই দেশের বয়সের সমান।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনন্দ কনফেকশনারি নামের বেকারি প্রতিষ্ঠানটি ১ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বিস্কুট তৈরি করে আসছে। তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকায় বহু দশক আগেই যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় ফ্রুট কেক।

ইউসুফ কনফেকশনারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য রুটি, বিস্কুট ও কেক তৈরি করতে শুরু করে। আর গত শতকের ৭০ ও ৮০'র দশকে কেক এবং পেস্ট্রির বাজারে আধিপত্য ছিল হোটেল পূর্বাণীর।

কিন্তু কেক এবং পেস্ট্রি শপের আধুনিক ধারণাটি প্রবর্তন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ব্রিটিশ সৈনিক ডগলাস জে এ কুপার।

কুপার ও তার বাংলাদেশি স্ত্রী সুফিয়া কুপার ঢাকায় কুপারস বেকারি নামে একটি ছোট দোকান স্থাপনের মাধ্যমে কেক এবং পেস্ট্রি ব্যবসায় নামেন। যাতে নগরবাসীকে ব্রিটিশ খাবারের সঙ্গে পরিচিত করানো যায়।

পরের বছরগুলোতে এর শাখা নগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসার ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কেক ও পেস্ট্রি ব্র্যান্ড চালু হয়।

এমনকি করোনাভাইরাস মহামারিও এই খাতের উদ্যোক্তাদের থামাতে পারেনি, যারা এই ব্যবসায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। গত ২ বছরে এ ধরনের শত শত নতুন দোকান স্থাপিত হয়েছে। কারণ লকডাউনে মানুষ অনেকটা সময় বাড়িতে কাটানোর জন্য কেকজাতীয় পণ্যের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বেড়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুপারস বেকারি মহামারির মধ্যেই নতুন ১৫টি শাখা খুলেছে। সব মিলিয়ে এখন এর শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২টিতে। এর মধ্যে ৬টি চট্টগ্রামে ও বাকিগুলো ঢাকায়।

মহামারির আগের ১ দশকে গড়ে ৭ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এবং যে কোনো উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে কেক।

এখন কেক কাটার পর্ব ছাড়া জন্মদিনসহ বিয়ে কিংবা বিয়ে বার্ষিকী, মা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস ও বড়দিনের মতো উৎসব পালন প্রায় অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও কেকের বড় ক্রেতা।

আর কেকের বিকিকিনির বিষয়টি এখন কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই।

দেশজুড়েই কেক ও পেস্ট্রির দোকান বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এর দোকানের সংখ্যা কয়েক হাজার। যা অন্তত ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করছে।

খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, দেশে কেকের বাজারের আনুমানিক আয়তন এখন প্রায় ৪০০ কোটি টাকার।

বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি কেক বিক্রি হয়। এর পরেই আছে ভালোবাসা দিবস।

বেকারি ব্র্যান্ড ব্রেড অ্যান্ড বিয়ন্ডের পান্থপথ শাখার একজন কর্মী জানান, গত ৩১ ডিসেম্বর কেবল এই শাখা থেকেই ৪৬টি কেক বিক্রি হয়েছে। 

৩ বছর আগেও ব্যস্ত এই এলাকাটিতে ২ থেকে ৩টি কেক ও পেস্ট্রির দোকান ছিল। এখন এর সংখ্যা প্রায় ডজনখানেক।

প্রাণ আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেকের বাজার আগে অসংগঠিত ছিল। এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড কর্তৃক খুচরা বিপণন ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে গ্রাহকরা মানসম্মত পণ্য পাচ্ছেন।'

প্রাণ ২০১৪ সালে কেক ও পেস্ট্রি ব্র্যান্ড টেস্টি ট্রিটের মাধ্যমে খুচরা খাদ্যপণ্যের বাজারে প্রবেশ করে। এখন এর ২৩০টির বেশি শাখা আছে।

পরে ২০১৫ সালে প্রাণ মিষ্টিজাতীয় পণ্যের ব্র্যান্ড 'মিঠাই' চালু করে, যা কেক ও পেস্ট্রিও বিক্রি করে। এখন এর শাখার সংখ্যা ১৩০টির বেশি।

কেক ও পেস্ট্রি ছাড়াও প্রায় প্রতিটি ব্র্যান্ড রুটি, বিস্কুট, ফাস্ট-ফুড, চকলেট ও মিষ্টির মতো বেকারি পণ্য বিক্রি করে।

একটি সাধারণ কেক কেজিপ্রতি ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। কিছু গ্রাহকের পছন্দ বিশেষ অথবা কাস্টমাইজড কেক। যার দাম শুরু হয় আড়াই হাজার টাকা থেকে।

ওয়েল ফুডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, তার ব্র্যান্ডটি বেকারি পণ্যের জন্য বিশেষায়িত হলেও কেক ও পেস্ট্রির ক্ষেত্রে এর শক্তিশালী অবস্থান আছে।

তিনি বলেন, 'মানুষের মধ্যে উৎসব উদযাপনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেক ও পেস্ট্রি বিক্রির হারও দারুণভাবে বাড়ছে। তাই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আমরা এর দিকে আরও নজর দিতে চাই। '

চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্র্যান্ডটি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল ১৮ বছর আগে। চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট মিলিয়ে এখন এর ৭০টি শাখা আছে।

এদিকে ফেসবুকভিত্তিক বাণিজ্যের কারণে ঘরে তৈরি কেকের চাহিদাও বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি কাজে লাগিয়ে অনেক অনেক নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন।

এমন একজন নারী হচ্ছেন গৃহবধূ হাফিজা খাতুন সীমা। তিনি ঢাকায় থাকেন।

মহামারির শুরুতে সীমা তার সন্তানের জন্য তৈরি নানা ধরনের কেকের ছবি আপলোড করতেন।

কয়েক মাস পর একজন ফেসবুকভিত্তিক খাদ্যপণ্য বিক্রেতা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তার গ্রাহকদের কাছে কেক পাঠানোর জন্য সীমাকে অনুরোধ করেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে সীমা বিষয়টি নিয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি তার প্রথম অর্ডারটি সরবরাহ করেন। এর পরের দিন একই গ্রাহকের কাছ থেকে আরও ৫টি অর্ডার আসে। যা সীমার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়।

কয়েক সপ্তাহ পর সীমা 'সীমাজ কিচেন' নামের একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। এ ক্ষেত্রে তার গ্রাহকরাই তার তৈরি কেকের সবচেয়ে বড় প্রচারকারী হয়ে ওঠেন।

সীমা বলেন, 'বাচ্চারা খুব পছন্দ করে বলে অনেকে মিষ্টির পরিবর্তে কেক নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায়। এ ছাড়া জন্মদিনেও কেক উপহার দিয়ে চমক দিতে চায় মানুষ।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
Yunus gives election preparation deadline

Complete polls preparations by December: Yunus

Asks to review if those who served as polling officers in past three elections shall not be assigned the same roles again

42m ago