ইফতারির পাঁচকথা

মন্থর বিকেল, সন্ধ্যা যেন হতেই চায় না। নগরীজুড়ে ঘরমুখী মানুষের তাড়াহুড়ো, কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখা; কখন নামে সন্ধ্যা! ফাঁকা হতে শুরু করে রাজপথ। ধীরে ধীরে নির্জনতার দিকে এগিয়ে যায় রাজধানী। সব ব্যস্ততা গিয়ে জমে ইফতারির দোকানগুলোতে। ফুটপাথের পাশে একমাসের আয়ু নিয়ে গজানো ওসব দোকানের কড়াইয়ে টগবগিয়ে ওঠা তেলের ফুসফাঁসের সামনে দাঁড়িয়ে কর্তা যখন ইফতারের পদ-প্রকরণ নির্ণয় করছেন, গৃহিণী তখন হয়তো বাড়িতে বসে লেবু কচলিয়ে শরবত তৈরিতে ব্যস্ত। রোজার মাসে সন্ধ্যাপূর্ব দৃশ্যপট অনেকটাই এ রকমই থোড় বড়ি খাড়া...। তবে আসল রঙ লাগে ইফতারির অস্থায়ী দোকানগুলোতে। মোড়ে মোড়ে ঋতু সুবিধায় চটুল হয়ে ওঠে ইফতারি বণিকেরা। কখনো কখনো এক দোকান-দুই দোকান করে গড়ে ওঠে ইফতারি বাজার। তারপর প্রতিবছর নিয়ম করে ওই জায়গাতেই বাজার বসানো, একসময় ঐতিহ্যের খাতায় নাম ওঠা। যদিও ‘পথ ইফতার বাজার’ বলতে যা বোঝায় এই নগরে তার সংখ্যা মোটে দুটি। আরো হয়তো আছে, কিন্তু সেগুলো স্বনামে দ-ায়মান হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। আর তাই ঘুরে-ফিরে প্রতিবছর ওই বেইলি রোড কিংবা চকবাজারই হয়ে ওঠে যক্ষের ধন। এ দুটি বাজার প্রসিদ্ধ হয়েছে এদের ইফতারের পদবৈচিত্র্যের বদৌলতে। বিশেষ করে নবাবী রসনাগুলো। এমন কিছু পদ এখানে মেলে, যা না বাড়িতে তৈরি করতে পারবেন, না বছরের অন্য সময় পাবেন। আর তাই জেলা-উপজেলার আনাচ-কানাচ থেকে রোজার মাসে যেকোনো একদিন হলেও এখানে ইফতারি কিনতে আসেন নগরবাসী। ‘মালাই পপ’ কিংবা আরবীয় মিষ্টি ‘কোনাফা’র কথাই ধরুন। একমাত্র প্রাপ্তিস্থান বেইলি রোড, তাও কেবল রোজার মাসেই। শান্তিনগর ছেড়ে পশ্চিমে বেইলি রোড। যদিও হাঁকডাক শুরু হয়ে যায় শান্তিনগর থেকেই। রোজার দিনে দুপুরের পর ওপথে গেলেই কানে ভেসে আসবে বিভিন্ন ঢঙে খদ্দের আহ্বানের মন্ত্র। বড় হাঁড়িতে হালিম নিয়ে বসে একটু পরপর হাঁড়ির ঢাকনায় সজোরে আঘাত করে বিক্রেতা বলে ওঠে ‘বাসায় লইয়া যান, সবাই মিল্লা খান’। বাসায় নিয়ে সবাই মিলে হালিম খেতে হলে হাঁড়ির আকার প্রতি গুনতে হবে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বা আরো বেশি। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন টেবিলে টেবিলে সাজানো বাহারি ইফতারি। মূল আকর্ষণ কাবাব। কাবাব বৈচিত্র্যের শীর্ষে সুতি কাবাব। তেমন কিছু নয়, গরুর মাংসের সঙ্গে জায়ফল, এলাচ, ঠসঠস, দারুচিনি, চন্দন, যষ্ঠিমধু, দেশি গোলাপ ফুলের শুকনো পাপড়ি ইত্যাদি মেশানো একপ্রকার আমিষ আর কী। কিন্তু কেন যেন খেতে বেশ ভালোই লাগে। শোনা যায় বেইলি রোডের ইফতারি পদ মূলত চকবাজারেরই অনুকরণ। সুতরাং চকবাজারের ইফতারি সম্পর্কে জানলেই বেইলি রোড সম্পর্কে ধারণা পাবেন। যদিও কেউ কেউ তা অস্বীকার করেন। তবে চকবাজারে যা নেই তা হচ্ছেÑ ‘বেইলি পিঠা ঘর’। বুট, মুড়ি, হালিম, কাবাব ইত্যাদি খাবার যাদের মুখে রোচে না, এই পিঠা ঘর তাদের জন্য বিরাট এক প্রাপ্তি হতে পারে। দামেও সস্তা। মূল উপাদান নারকেল, দুধ, ঘি, চাল, চিনি সহযোগে প্রায় ৩৭ প্রকার পিঠা পাবেন এখানে। হরদরে প্রতিটির দাম পড়বে ২০ থেকে ২২ টাকার মধ্যে। এখানেই পাবেন তেলের পিঠা, ক্ষীর দেয়া পাটিসাপটা, পান পিঠা, চিতই, পাকান, ভেজানো পিঠাসহ হরেক রকমের পিঠা।


বেইলি সাহেবকে ছেড়ে চলুন ঘুরে আসি ইফতারির মহাসাম্রাজ্য চকবাজারে। চক সার্কুলার রোডের মুখে ঢুকতেই শোনা যাবেÑ ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়’। এই এক পদ (অনেকের কাছে আপদ) নিয়েই মানুষের যত কৌতূহল। বড় বাপের পোলা নামক এই মহার্ঘটি মূলত ৩৬টি বিভিন্ন ইফতারির পদ এবং ২৭ প্রকার মসলার একটি মুখরোচক মিশ্রণ। কাবাবের পদেরও কমতি নেই। কদমে কদমে এগিয়ে যাবেন আর দেখতে পাবেনÑ গরু ও মুরগির কোপ্তা, মোরগ মোসাল্লাম, মেজবানি মুরগি, গরু ও খাসির সুতি কাবাব, গরুর চাপ, কোয়েলের রোস্ট, ডিমের বার্গার, চিকেন রোস্ট ইত্যাদি। এসবের সহপদ হিসেবে পরোটাও মেলে ওখানে। চোখ আটকায় জিলাপির দিকেও। দেখে চিনতে পারলেও বিশ্বাস করতে দ্বিধায় পড়তে পারেন যে ওটা আদৌ জিলাপি কিনা; কারণ এর আকার। একেকটি প্রায় ভাতের থালার চেয়েও বড় মাপের; নাম শাহি জিলাপি। ক্রেতাদের আরেক আকর্ষণ দইবড়ার দিকে। যেসব পদের জন্য চকবাজারের ইফতারির এত নামডাক, দইবড়া সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। যাহোক, হকচকিয়ে যেতে হয় একটি শরবতের নাম শুনলে। ফলের শরবত হয় জানতাম তবে চাল দিয়েও যে শরবত হয় জানা ছিল না। কিন্তু হয়, যার নাম ফালুদার শরবত। এটি পোলাও চাল দিয়ে তৈরি একপ্রকার শরবত। এসব কিনতেই প্রতিবছর ওখানে ক্রেতার সমাগম ঘটে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের জবাব দেন ওখানেই উপস্থিত থাকা এক আগন্তুক ক্রেতা। আশুলিয়া থেকে চকবাজারে ইফতারি কিনতে আসা এই ক্রেতা বলেন, ‘ঐতিহ্যের টানেই এখানে ছুটে আসা। আমি তো প্রতিবছর রোজায় একদিন হলেও এখান থেকে ইফতারি কিনে নিই। এখানকার ইফতারিগুলো আসলেই ব্যতিক্রম, স্বাদেও ভিন্নতা আছে, আর দামও আহামরি কিছু নয়।’ যাক, ওই ক্রেতার কাছে যা আহামরি নয়, অন্যের কাছে তা আকাশচুম্বী হতেই পারে। তাই দামদর নিয়ে দু’চরণ লিখেই দিই। দইবড়া বাটির পরিমাপ অনুসারে ৬০ থেকে ২০০ টাকা, সুতি কাবাবের কেজিÑ গরুর ৬০০ টাকা এবং খাসির ৭০০ টাকা, শাহি জিলাপি ১৬০ টাকা, বড় বাপের পোলায় খায় ৪০০ টাকা, স্পেশাল পরোটা ৪০ টাকা পিস, মোরগ মোসাল্লাম দেশি ৩০০ টাকা এবং ব্রয়লার ২৫০ টাকা, কোয়েল রোস্ট প্রতি পিস ৬০ টাকা, হাঁসের রোস্ট ৩০০ টাকা, মেজবানি মুরগি ২৫০ টাকা, মালপোয়া ২০ টাকা, মুরগির গিলা-কলিজা ভুনা ৩০০ টাকা, ডিম বার্গার ৪০ টাকা, খেজুর প্রকারভেদে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি, ফালুদার শরবত ২০ টাকা। এছাড়াও বেইলি রোড বা চকবাজার উভয় স্থানেই মিলবে আচার এবং দেশি-বিদেশি ফল-ফলাদি।


রোজার মাসজুড়েই জমজমাট বেইলি রোড ও চকের ইফতারির বাজার। দিনে দিনে ম্রিয়মাণ ঐতিহ্যের শেষ শিখাটুকু জ্বালিয়ে এখনো বনেদি ইফতারির আয়োজক রাজধানীর এ দুটি স্থান। মন টানলে একদিন ঢুঁ মেরে দেখে আসতে পারেন বাজার দুটির কেতা। আর ইফতারি কেনা? সে তো নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত অভিরুচি।
 শিবলী আহমেদ
ছবি : সংগৃহীত

 

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago