ঈদ সাজ
সবচেয়ে আনন্দের দিনে চাই
নিখুঁত সাজ। ধর্মীয় উৎসবগুলোর মাঝে সব থেকে বড় উৎসবটি
চলে এসেছে ঘরের দোরগোড়ায়। ঈদুল ফিতর। বড় উৎসবে চাই স্পেশাল সাজ। তবেই না উৎসব হবে পরিপূর্ণ। ঈদের সাজ ও
ফ্যাশনের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন খাদিজা ফাল্গুনী
ঈদের সাজ আর পোশাকের যুগল না মিললে নিজেকে খাপছাড়া দেখায়। অনেকেই এই দিনটিতে মনের মতো যত ফ্যাশন আর সাজ আছে দুটোই অ্যাপ্লাই করতে চান। কিন্তু দুটো দু’মেরুর হলেই সমস্যা। দুটোর মিশেলে নিজেকে অদ্ভুত দেখালেই সারাটা দিন মাটি। আবার এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে এমন কোনো বিউটি ট্রিটমেন্টও অ্যাপ্লাই করা ঠিক না যেগুলো স্বাভাবিক হতে অনেকদিন লাগে। তাই রমজানের ধৈর্য দরকার ঈদের দিনেও। ঈদের সময়ে সাজ ও পোশাক মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একটি হলো পোশাক, অন্যটি আবহাওয়া। এমন কোনো পোশাক পরা উচিত না, যেটা আপনার আবহাওয়ার সঙ্গে ক্লাস করে আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে। আবার এমন কোনো সাজও ঠিক না, যেটা আপনার পোশাক আর আবহাওয়া দুটোর সঙ্গেই বেমানান হবে। আজকাল অধিকাংশ ফ্যাশন সচেতন মানুষই একটার বেশি ঈদের জামা কেনেন। যারা একটাই কেনেন, তারা দেখা যাচ্ছে ঈদের দিনের আয়োজন কিংবা পার্টি মাথায় রেখে পোশাকটা বেছে নেন। তাই দেখে নিতে পারেন ঈদের দিনে কেমন হতে পারে সাজ ও পোশাকের মিশেল।
ঝলমলে সকালে
ঈদের দিন সকালে রোদ এবং বৃষ্টি দুটোই থাকার সম্ভাবনা আছে এবার। কিন্তু ভয়ানক গরম থাকবে, এটা নিশ্চিত। তাই সকালের সাজটা হওয়া চাই ¯িœগ্ধ ও ঝলমলে। প্রথমেই ঠিক করে নিন, ঈদের দিন শাড়ি পরবেন নাকি সালোয়ার-কামিজ। যদিও বিশেষ আয়োজন ছাড়া আজকাল মেয়েরা শাড়ি কম পরে। তবুও ঈদের দিন সকালে শাড়ি বেছেই নেয়া যায়। ঈদের চেয়ে বিশেষ আয়োজন তো খুব একটা আসে না। সাধারণত সকালটা পরিবারের সঙ্গেই কাটানো হয় সবার। এমন সময়ে হালকা রঙের পোশাক সুন্দর লাগে। শাড়ি পরতে না চাইলে তরুণীদের জন্য বা বাড়ির মেয়েটির জন্য হালকা সুতি সালোয়ার আরামের জন্য হতে পারে সেরা বাছাই। একটু যারা সিনিয়র হয়ে গেছেন, তারা নির্দ্বিধায় বেছে নিন শাড়ি। সাদা জমিনের ওপরে লাল, কমলা, মেরুন এবং কালোর মিশেলে করা শাড়িগুলো ঈদের দিন ভারি সুন্দর দেখায়। তাঁতের সুতি শাড়ি বেছে নিতে পারেন হালকা পাড়ের কোনো। বর্ষা আর গরমের এমন ভ্যাপসা দিনে সাদা জমিনে বাহারি পাড়, আঁচলে নকশা কিংবা লাল-হলুদ রঙের মিশ্রণে আপনাকে যেমন ঝলমলে, তেমন সতেজ দেখাবে। একছড়া মুক্তো বা পাথরের মালা আর দুল পরতে পারলে সাজে আসবে ভিন্ন মাত্রা। অথবা সঙ্গে কানে ছোট টপ, হাতে পাতলা কোনো ব্রেসলেট বা চুড়ি, গলায় ছোট লকেট বা পাতলা চেইন আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। সেটা ম্যাট হলেই ভালো হয়।
ঈদের এখন সব বয়সীদের জন্য শাড়ি এনেছে ফ্যাশন হাউসগুলো। সেখানে চার বছরের ছোট্ট নাতনি যেমন বাদ পড়েনি, তেমনি আশি বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যটিও বাদ পড়েননি। অঞ্জন’স-এর মতো ফ্যাশন হাউসে মায়ের সঙ্গে মেলানো শিশুর শাড়ি পাবেন। চাঁদনী চক, গাউছিয়া, নিউমার্কেটেও পাওয়া যাবে এমন শাড়ি। আবার রঙ বাংলাদেশে পাবেন সিনিয়র সদস্যদের জন্য তৈরি শাড়ি। তাদের শাড়ি মানেই যে সাদা হবে, এমন ধারণা একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে। বরং পিচ, মেরুন, সফট পিংক, হালকা হলুদের মাঝেই পাবেন চোখ জুড়ানো সব শাড়ি। আর অন্যদের জন্য এবারের ঈদে সেরা চমক থাকবে সিল্কে। প্রায় সবগুলো হাউস তাদের প্রধান কালেকশন রেখেছে সিল্কের শাড়ি। জয়পুরি, অ্যান্ডি, হাফ সিল্কের জমকালো বাহার দেখবেন এবারের ঈদে। দেখতে যেমন ঝলমলে, তেমনি পরতেও আরাম। রঙও ফোটে ভালো। পাশাপাশি দেখবেন মসলিন, কাতান আর জামদানি। তাতে ভারী আঁচল, আর এম্ব্রয়ডারি দেখা যাবে।
দুপুরের দাওয়াতে
দুপুরের দাওয়াত যতটা না পোশাকের আড়ম্বর থাকে, তারচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় ছিমছাম সৌন্দর্য। সেজন্য সাহায্য নিতে পারেন সাজ প্রসাধনীর। খুব বেশি সাজতে না চাইলে মুখ পরিষ্কার করে ময়েশ্চারাইজার, অ্যাসট্রিনজেন্ট ও সানব্লক লাগিয়ে নিন শুধু। রোদ থাকুক বা না থাকুক, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব থাকে সবসময়। তার ওপরে হালকা কমপ্যাক্ট পাউডারের পাফ বোলালেই আপনার বেজ সম্পূর্ণ। হালকা লাইনার বা কাজলের রেখা টেনে, ঠোঁটে লাগান একটু উজ্জ্বল কোনো বেজ লিপস্টিক। একটু ভারী সাজ নিতে চাইলে মুখ পরিষ্কার করে প্রথমেই কনসিলার ব্যবহার করে দাগ ঢেকে নিন। তার ওপর লাইট ফাউন্ডেশন এবং কমপ্যাক্ট লাগান। দিনে ব্লাশন না লাগানোই ভালো। খুব বেশি প্রয়োজন হলে হালকা কমলা, বাদামি ও পিচ শেডগুলো বেছে নিন। এগুলো ত্বকে সতেজ ভাব নিয়ে আসে আবার অতিরিক্ত সাজের অনুভূতিও দেয় না। চোখে হালকা শ্যাডো লাগিয়ে তার ওপর কাজল টেনে মিশিয়ে নিন। পাপড়ির দু’পাশেই মাশকারা দিন। ছোট্ট একটা টিপ পরতে পারেন, পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে লাগাতে পারেন লিপস্টিক ও নেইলপলিশ। এতেই আপনাকে সতেজ ও আকর্ষণীয় দেখাবে। আর শাড়ি না পরতে চাইলে দুপুরের আয়োজনে অবশ্যই কোনো ফরমাল পোশাক যেমন সালোয়ার-কামিজ বাছুন। নানা রকম অস্বস্তি থেকে বাঁচবেন।
বিকেলের আড্ডায়
ঈদের বিকেলে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘোরাফেরার মজাই আলাদা। কৈশোরে পা যাদের, ঈদের দিন বিকেলে তাদের ধরে রাখাটা সত্যিই একটু কঠিন। এই সময়টাই মূলত এক্সপেরিমেন্টের। ওয়েস্টার্ন বা ফিউশন পোশাকই বেশি মানায় ঈদের দিন বিকেলে, বন্ধুদের আড্ডায়। এ বছর টপসের বাহারে যোগ হয়েছে শার্ট টপস। যেগুলো রঙিন চাপা পাজামা থেকে শুরু করে ফ্যাশনেবল প্যান্টের সঙ্গেই মানিয়ে যায়। তাতে ফুলেল ও জ্যামিতিক মোটিফ দেখা যাচ্ছে বেশি। রঙের নানা শেড থাকবে নকশাজুড়ে। জামায় ফিতার যেমন কাজ দেখা যাচ্ছে, তেমনি বোতাম ও ফুলের অনুষঙ্গ বেড়েছে। প্যান্টে পাবেন নানা বাহার। সত্তরের প্যান্টগুলো দারুণ চলছে এবারের ঈদে। টিনদের যেকোনো বিকেলের আড্ডায় এমন পোশাক চলবে অনায়াসে। সঙ্গে একটু ঊঁচু করে বাঁধা চুল, সামার বব কিংবা শ্যাগি কাটের চুলেই পুরো লুক হবে সম্পূর্ণ।
জমকালো রাতের আয়োজনে
ঈদের সন্ধ্যার বা রাতের সাজের জন্য চোখ বুজে বেছে নিন সিল্ক, জামদানি, কাতান কিংবা কোটা শাড়ি। যেকোনো বয়সেই সন্ধ্যার পার্টিতে শাড়ি মানিয়ে যায়। একটু গাঢ় রঙের শাড়িতে আপনাকে গর্জিয়াস দেখাবে। তাই সিল্কের ওপরে রেশমি সুতা আর জারদৌসির কাজ করা ময়ূরকণ্ঠী হতে পারে প্রথম পছন্দ। অথবা অফ হোয়াইট বা বেজ কালারে ব্রাশ প্রিন্ট, জরিপাড় বা বড় আঁচলের বুটিকদার কাতান আপনাকে সবার মাঝে আলাদা করে তুলবে। গয়না বেছে নিন সোনার বা জয়পুরি ইমিটেশনের। একটু ভারী গয়না বাছুন, যদিও সেটা নির্ভর করবে আপনার রুচি আর বয়সের ওপর। কুর্তা বা সালোয়ার-কামিজ বাছতে চাইলেও আয়োজনকে মাথায় রাখুন।
সান্ধ্যসাজে চাই মনকাড়া আভিজাত্য। প্রথমে মুখ পরিষ্কার করে প্রাইমার এবং ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। এরপর একে একে কনসিলার ও ফাউন্ডেশন। অবশ্যই খেয়াল রাখেবেন গলা এবং কানের উপরিভাগের দিকে। যাদের হাতের এবং মুখের রঙে বেশিই বৈসাদৃশ্য, তারা অবশ্যই হাতেও প্যানকেক এবং ফাউন্ডেশন লাগিয়ে নেবেন। এবার কমপ্যাক্ট লাগিয়ে মসৃণ করুন বেজ। এ সময় অবশ্যই গালে ব্লাশন ব্যবহার করুন। খেয়াল রাখবেন সেটা যেন দিনের চেয়ে কয়েক টোন গাঢ় হয়।
রাতের সাজের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ চোখ। এখন গাঢ় ভ্রুর ট্রেন্ড চলছে। তাই বাদামি এবং কালোর মিশেলে একটু টেনে ভ্রু আঁকুন। নিচে হাইলাইটার দিয়ে ভ্রুকে বোল্ড করে নিন। চোখে শ্যাডো অ্যাপ্লাই করার আগে প্রাইমার ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে চোখ যেমন নিরাপদ থাকে, শ্যাডোও গলে যায় না। রাতের আয়োজনে প্রায় সবাই একাধিক শেড ব্যবহার করে থাকেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন শেডগুলো যেন ভালোভাবে ব্লেন্ড হয়। একটি শেড ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে গাঢ় একটি শেড বেছে নিন। সঙ্গে অবশ্যই আইল্যাশ ও মাশকারা ব্যবহার করবেন ও গাঢ় করে কাজল দেবেন। লিপস্টিক ব্যবহারের আগে অবশ্যই লিপব্রাশ বা লিপলাইনার দিয়ে ঠোঁটে লাইন টেনে নিন। আর অবশ্যই লিপস্টিক লাগানো শুরু করবেন ঠোঁটের মাঝ থেকে। এখন গাঢ় রঙের ট্রেন্ড চলছে। তাই মেরুন, ডার্ক রেড কিংবা চকলেটের শেডগুলোও বেছে নিতে পারেন নির্দ্বিধায়।
ছেলেদের জন্য
ঊৎসবের দিনে ছেলেদেরও চাই স্পেশাল লুক। যদিও তাদের বিশেষ যতœআত্তি শুরু করতে হয় ঈদের আগে থেকেই। একটু সাবধান হলেই তারা ঈদের দিনের কাক্সিক্ষত লুক আনার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে অনেকটুকু রেহাই পেতে পারেন।
তাই ঈদের অন্তত এক সপ্তাহ আগেই চুল কাটিয়ে নিন। ওই সময়েই চাইলে স্যালনে ফেসিয়াল করে নিন। পাশাপাশি পেডিকিওর এবং মেনিকিওর। ঈদের দিন আপনার অর্ধেক টেনশন কমে যাবে। পাশাপাশি ঈদের দিন পরার বিশেষ আনুষঙ্গগুলোও গুছিয়ে ফেলুন। সানগ্লাস, ঘড়ির পাশাপাশি সকালে নামাজে যাওয়ার টুপিটিও পছন্দ করে কিনে রাখুন। এই দিনে অনেকেই আতর ব্যবহার করেন। আপনি চাইলে পছন্দের আতর বা পারফিউমও কিনে আলাদা করে রাখুন আগেই।
ঈদের সকালে পায়জামা-পাঞ্জাবি ছেলেদের সেরা পোশাক। দিনের আড্ডা বা ঘোরাঘুরির জন্য বেছে নিতে পারেন উজ্জ্বল রঙের টি-শার্ট, পোলো-শার্ট বা ক্যাজুয়াল শার্ট। চুলে জেল দিয়ে স্টাইল করতে পারেন। আর রাতের আয়োজনে পাঞ্জাবি থাকলে ক্ষতি নেই। তবে ফরমাল পার্টি না হলে পোলো শার্ট বা ক্যাজুয়াল শার্ট-প্যান্ট মানাবে বেশ। হাতে বড় ডায়ালের একটি ঘড়ি আর পাট করে আঁচড়ানো চুল ছেলেদের সব আয়োজনেই আকর্ষণীয় করে তোলে। পাঞ্জাবি পরলে বেছে নিন নাগরা, স্যান্ডেল সু বা স্যান্ডেল। আর ফরমাল পোশাকে মোকাসিনো বা চিরাচরিত অক্সফোর্ড সু। ক্যাজুয়াল শার্ট বা পোলোর সঙ্গে লোফা বেশ যাবে। ফরর্মল মোকাসিনোর বদলে এর মতোই ফ্যাশনেবল ক্লোজড সু মন্দ লাগবে না।
ঈদের আয়োজন থাকে সারা মাসজুড়ে, আর ঊৎসব মাত্র একদিনের। তাই আবহাওয়া আর পরিবেশ বুঝে সাজ ও পোশাক বেছে নিতে পারাটা খুব জরুরি। একদিনের আয়োজনের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময়। সেই শুভকামনা সবার জন্য। ঈদ মোবারক।
পোশাক : টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির
সেইলর, স্বপ্ন, রোজ
মডেল : শ্রাবস্তী, ইন্দ্রানী
রিসিলা, রিপন, মাশিয়াত
ছবি : সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ
Comments