উত্থানপর্বের সুখস্মৃতি

তখন আশির দশক। পড়ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। দেশের অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা রীতিমতো বিধ্বস্ত। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করেছেন। একজন ব্রিটিশ ইকোনোমিস্ট লিখেছেন, এই অবস্থা থেকে যদি বাংলাদেশের অর্থনীতি উৎরে যেতে পারে, পৃথিবীর যেকোনো দেশের অর্থনীতির পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব। এমন এক অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতকোত্তর শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে চলে যাই দেশের বাইরে, আমেরিকার ড্রেক ইউনিভার্সিটিতে। এটি ১৯৮৭ সালের কথা।


আমেরিকায় প্রথম দিনের স্মৃতি এখনো মনে পড়ে আমার। আগের রাতেই তুষার পড়ছিল, পরদিন সকালে উঠে দেখি চারদিক ধবধবে সাদা। এমন জনবহুল একটা দেশকে হাড় কাঁপানো ঠা-ার কারণে দেখাচ্ছে পুরোপুরি জনশূন্য। একটি মানুষও নেই রাস্তায়। জীবনধারণের উপযোগী সামান্য একটু আরামদায়ক আবহাওয়ার পেছনেই চলে যাচ্ছে কত সম্পদ। নিজের জন্য কিছু কিনতে মার্কেটে গেলে প্রায়ই বিভিন্ন দেশের ট্যাগ দেয়া পণ্য চোখে পড়ত। মনে হতো, মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগে তো তাহলে এখানেও বাংলাদেশের পণ্য আনা সম্ভব। আর এরা এত প্রতিকূল আবহাওয়ায় থেকেও এত উন্নতি করছে, সেখানে আমরা তো রীতিমতো ভাগ্যবান। এদের তুলনায় আমাদের দেশে শীতের প্রকোপ নেই বললেই চলে। ওই একটি বিষয়ই আমার মনে স্ট্রাইক করেছিল। এভাবেই পড়া শেষ হলো, রেজাল্ট হলো ভালোই। দেশে ফিরে এলাম। বড় দুই ভাই, মোহাম্মদ আব্দুল মোয়িদ এবং প্রফেসর (ড.) মুহাম্মদ আব্দুল মঈনের সঙ্গে আবার কাজ শুরু করলাম নিজেদের টেক্সটাইল মিলে।  
ততদিনে দেশে আমাদের টেক্সটাইল মিলটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ১৯৮২ সালে আমরা ভারত থেকে কিছু নতুন প্রযুক্তির মেশিনারিজ এনে কাপড় তৈরি শুরু করি। দেখলাম, খুব ভালো মানের কাপড় তৈরি হচ্ছে। ওই সময়ে লোকাল আর আমদানি করা কাপড়ের বড় বাজার ছিল ইসলামপুরে। আমাদের কাপড় আমরা ইসলামপুরে পাঠানো শুরু করলাম। বিটিভিতে একটু-আধটু বিজ্ঞাপন করা হলো। তাতেই রাতারাতি সফলতা। পরে ইসলামপুরের বিক্রেতারা আমাদের কাপড় তাদের ব্র্যান্ডের অধীনে বিক্রি করতে শুরু করল। দুই থেকে তিন বছরের মাথায় তারা চরম মুনাফা পেতে শুরু করল, আর দিনে দিনে আমরা দাম কমাতে বাধ্য হতে লাগলাম। খুব সূক্ষ্ম একটা খেলা ছিল এটি। এভাবে চলল আটাশি সাল পর্যন্ত।


এর কয়েক বছর পরেই আমরা সিদ্ধান্তে আসি, নিজেদেরকেই সরাসরি ক্রেতার মাঝে আসতে হবে। এভাবেই তৈরি প্রাইড টেক্সটাইল। ইসলামপুরে পাইকারি মার্কেটেও কাপড় যেত, পাশাপাশি নিজেরাই নিজেদের অন্য একটা ব্র্যান্ড, প্রাইডকে তৈরি করতে লাগলাম। প্রাইড যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল, সেদিন আমরা পাইকারি বাজারে কাপড় দেয়া বন্ধ করে দিলাম। নো নেম ব্র্যান্ড থেকে অবশেষে প্রাইড পেল নিজের পরিচয়।


আমাদের টার্গেট ছিল রুচিশীল ক্রেতা, যারা যেনতেন শাড়ি পরেন না। বলতেই হয়, এই রুচি তৈরিতে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আমার পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে আমাদের মায়ের। মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন আমার অসম্ভব রুচিশীল মা, মার্জিত নকশা আর রঙের ব্যাপারে কড়া নজর ছিল তার। যেটা ছোটবেলা থেকেই প্রবাহিত হয়েছে আমাদের সবার মাঝে। ছোটবেলায় যখন সবাই মিলে আমাদের ছোট্ট অস্টিন গাড়িতে করে স্কুলে যেতাম, বড় ভাই নিজের হাতে নাশতা তৈরি করে, খাইয়ে আমাদের রেডি করে নিয়ে যেতেন। স্কুল শেষে বাবার অফিসের সামনের বিশাল মাঠে খেলাধুলা, আবার একসঙ্গে সবাই মিলে বাড়ি ফেরা। পল্লবীর ওই বাড়িতে অনেক প্রতিবেশী মিলে ছিল একটি পরিবারের মতো। পরিবারের এই বন্ধনটা প্রাইডকে সবসময় এক লয়ে কাজ করে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে।
আমরা যখন এগিয়েছি তখন ব্র্যান্ড তৈরি করেছি, বাইরে যা কিছু দেখেছি তা নিজেদের মতো করে ডিজাইন করেছি। কাপড়ের মান ভালো কি না এটা নিশ্চিত করতে কাপড়কে বেশ কিছু টেস্টিং প্যারামিটারের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। এগুলোর মাঝে থাকে লাইট পাস টেস্ট, ওয়াশিং পাস টেস্ট, রাবিং পাস টেস্টের মতো আরো কিছু ধাপ। যে কথাগুলো আমাদের সেলসম্যানরা বোঝাতে পারত না, সেগুলো নিজেরা ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝিয়েছি, শো-রুমেই স্যাম্পল রেখেছি। এই যাত্রাটা কোনোভাবেই সহজ ছিল না এবং নিষ্ফলও হয়নি। একজন উদ্যোক্তার তো শুধু সৃজনশীলতা থাকলেই হয় না। তাকে একইসঙ্গে ডিজাইন বুঝতে হয়, ক্রেতার পছন্দ, চাহিদা, আরাম বুঝতে হয়, সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব দিতে জানতে হয় এবং সবকিছুর সমন্বয় করতে হয়। পুরো প্রচেষ্টাতে সৃজনশীলতার কমতি থাকলে কোনোদিনই কোনো উদ্যোক্তা দাঁড়াতে পারতেন না।


সত্যি বলতে কী, এতদিনের যাত্রায় কখনই ক্লান্তি আসেনি। প্রায় ২৭টি দেশ ঘোরা হয়ে গেছে আমার। যেখানে যা ভালো লেগেছে, নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি এখানে। নিজের মতো করে আরো উন্নত কাপড়ের কৌশল নিয়ে ভাবা, ক্রেতা সেবার যে সুনামটি তৈরি হয়েছিল প্রথমেই সেটিকে আরো উন্নত করার চেষ্টার মাঝেও এক ধরনের অনুপ্রেরণা থাকে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাই, আর আমার স্টুডেন্টদের দেখি, ভাবতে ভালো লাগে যে অসংখ্য তরুণের জীবন তৈরি করে দেয়ার কাজ করছি। দেশকে সবচেয়ে সেরা কাপড়টি দেয়ার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে প্রাইড। রঙ ও নকশা ভালো, আর ধুলেও দেশি কাপড়ের রঙ ওঠে না। ওই এক সুনামের জন্য হলেও এ দেশের যেকোনো মানুষ কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেই প্রাইডের একটা শো-রুম বের করে ফেলতে পারবে। যেটা আমরা কাপড় আর কাজের মান দিয়ে অর্জন করেছি। বাংলাদেশ এখন আর সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, এখন তা কাজে লাগানোর অপেক্ষা শুধু।

Comments

The Daily Star  | English
Ishraque Demands Advisers Asif, Mahfuj Alam Resign

Protests continue as Ishraque vows to stay on streets until advisers resign

Protests rolled into this morning as BNP activists and leaders held their ground in front of the mosque, demanding that Ishraque be allowed to take the oath as mayor

2h ago