কলসিন্দুর রূপকথার অনাকাঙ্ক্ষিত গল্প

মূলধারার মিডিয়াতে যখন কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্যের গল্প ছড়িয়ে পড়ে, তখন এটা শুধু ক্রীড়াঙ্গনই নয়, সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন ফেলে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট গ্রামে ভোর হতো তখন ফুটবলের শব্দে।

মূলধারার মিডিয়াতে যখন কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্যের গল্প ছড়িয়ে পড়ে, তখন এটা শুধু ক্রীড়াঙ্গনই নয়, সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন ফেলে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট গ্রামে ভোর হতো তখন ফুটবলের শব্দে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সব রূপকথার গল্পের শেষটা সুখের হয় না। বিষয়গুলি সেখানে যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, এই উদীয়মান মেয়ে ফুটবলারদের গল্প যদি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে জায়গা না হতো, তাহলে এই কলসিন্দুর গল্পটি একটি শহুরে কিংবদন্তি বা ইতিহাসের পাদটীকা ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠত না।

২০১১ সালে এক নতুন গল্পের সূচনা হয়েছিল মারিয়া মান্ডা এবং তাদের বোনদের হাত ধরে। সে ধারায় ২০২১ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের ফুটবলে এমন বিস্ফোরণ তৈরি করেও চলমান এমন উন্নয়নের সাক্ষী হওয়া তাদের জন্য অন্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।

উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে 'ইংলিশ ফর টুডে'তে 'দ্য আনবিটেন গার্লস' শিরোনামের গল্পটি মারিয়া, সানজিদা আক্তার ও তহুরা খাতুনের মতো মেয়েদের সংগ্রামের কথাই তুলে ধরে। এই ধরনের একটি গল্প, দেশের পাঠ্যপুস্তকে যা প্রথমবারের মতো ছাপা হয়, স্পষ্টতই কলসিন্দুরের বাসিন্দাদের গর্বিত করে। সেই ইতিহাসের কথা পড়ে তাদের সকলের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।

কলসিন্দুরের গামারিটোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন থেকে শুরু করে কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ইংরেজির শিক্ষক আবদুল হামিদ, কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মালা রানী সরকার, কোচ জুয়েল মিয়ার কাছেও তাদের নিজস্ব কিছু পাঠ্যপুস্তকের মতো মর্যাদাপূর্ণ কিছুতে দেখা একই রকম গর্বের।

এ প্রসঙ্গে মালা রানী বলেন, 'আমরা যা পেয়েছি তা আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে।'

যদিও প্রত্যাশা একটি কৌশলী জিনিস। প্রায়শই, বাস্তবতার ভারে সে প্রত্যাশা অনেক কমে আসে। এই ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। কেন ২০১৮ সালে কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল কোচিং বন্ধ হয়ে গেল? অথচ এই কলসিন্দুরেই ফুটবল দেবতারা ২০১১ সাল থেকে জয়গান গেয়েছেন। ফুটবল প্রতিভার একটি অসাধারণ পাইপলাইন উন্মোচিত হয়েছে এখান থেকেই।

মফিজ উদ্দিন, রূপকথার মূল স্থপতিদের একজন, যদিও তিনি সবচেয়ে নির্ণায়ক নন, তবে কী ভুল হয়েছে তার উপর আলোকপাত করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী শিক্ষক মফিজই ২০১১ সালে সব জড়তামূলক প্রতিরোধ ভেঙে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মেয়েদের কোচিং করা শুরু করেছিলেন। তার অধীনেই দলটি দুর্দান্ত খেলতে থাকে, একের পর এক শিরোপা জিতে নেয় এবং ২০১৬ সালে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়।

২০১৬ সালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় মফিজ জানিয়েছিলেন, বিরোধের শুরুটা হয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কলসিন্দুর সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে খেলার কারণে পাওয়া টাকা ভাগাভাগি নিয়ে। সে বছর প্রাইমারি স্কুলের খাতায় এক ব্রিটিশ প্রবাসীর ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার ঘটনায় এর তীব্রতা বেড়ে যায়।

কলসিন্দুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনোতি রানী শীলের মতে, স্বার্থান্বেষী এবং ভ্রান্ত উদ্দেশ্যের লোকদের একটি অংশ- তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত, অনুদানটি যেভাবে করা হয়েছিল তা ব্যবহার করা যায়নি।

'এটি সত্যিই আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে এবং এক পর্যায়ে আমরা কোচিং বন্ধ করতে বাধ্য হই,' মিনোতি জানান।

২০১৬ সালে উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেভাবে মেয়েদের জন্য একটি ভিন্ন কোচিং প্যানেল নিয়োগ করে এবং তাতে প্রাইমারি স্কুলে দেশের মন্ত্রমুগ্ধ মেয়েদের ফুটবল কোচিং সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তা স্মরণ করে দুঃখ প্রকাশ করেন মফিজ।

উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোচিং পুনরায় চালু করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন মিনোতি কারণ সম্প্রতি তারা প্রশাসনের কাছ থেকে একটি ন্যায্য তহবিল পান কিন্তু এটা এখনও সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ থাকলেও, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফুটবল কোচিং শীঘ্রই পুনরায় শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন উচ্চ বিদ্যালয় দলের বর্তমান ম্যানেজার মালা রানী। এরমধ্যে মোহাম্মদ এনামুল হক (ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক) এবং শফিকুর রেজা বিশ্বাস (ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার) কলসিন্দুর পরিদর্শন করেছেন এবং তারা সেখানে নারী ফুটবলের উন্নয়নের জন্য পাঁচ লাখ টাকার একটি তহবিল সংরক্ষণ করেছেন বলে জানা গেছে।

তহুরা খাতুনের মতো কেউ, যিনি জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, এই বছর কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন, বলেছেন যে তাদের নিজের অর্জনের গল্প পড়ার চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিছুই হতে পারে না।

কিন্তু গভীরভাবে, প্রচলিত বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, তহুরা এবং দলটি তাদের মতো পরবর্তী প্রজন্মের অঙ্কুরিত হতে দেখতে আগ্রহী হবে। তাদের প্রিয় পরামর্শদাতা, মফিজ বলেন, 'কলসিন্দুর ফুটবলের ভবিষ্যতের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই মেয়েদের গঠন করতে হবে, যা কেবল পাঠ্যপুস্তকে নয়, মাঠেও রঙিন হওয়া উচিত।'

Comments

The Daily Star  | English

Deeper crisis feared as 219 factories shut

With 219 garment factories shut in Ashulia yesterday amid worker unrest along the industrial belts, Bangladesh’s apparel sector is feared to get into a deeper crisis if production does not resume on Saturday after the weekend.  

4h ago