কিংবদন্তি ফুটবলার এনায়েতের সঙ্গে আড্ডা

Enayetur Rahman Khan
শনিবার পুরনো স্মৃতি তুলে ধরছেন এনায়েতুর রহমান খান।

বাংলাদেশের ফুটবলে কিংবদন্তি এক নাম এনায়েতুর রহমান খান। তাকে মানা হয় বল পায়ে দেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই খেলোয়াড় অভিমান নিয়ে দেশ ছেড়ে  লম্বা সময় ধরে ছিলেন আড়ালে।  দীর্ঘ ২৭ বছর পর এ ফুটবলার কানাডা থেকে দেশে ফিরলে তাকে ঘিরে এক আড্ডার আয়োজন করে  বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (বিএসজেএ)।

১৯৯৪ সালে দেশকে বিদায় জানিয়ে যাওয়ার আর স্বদেশে পা পড়েনি তার। গত ১৮ ডিসেম্বর কানাডা থেকে দেশে ফেরেন এনায়েত। শনিবার বিএসজেএর কার্যালয়ে 'কিংবদন্তীর সঙ্গে' শিরোনামে আড্ডায় উপস্থিত হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সঙ্গে ছিলেন তার সতীর্থ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, শেখ আশরাফ আলি। এসেছিলেন আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম সারোয়ার টিপু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, খুরশিদ বাবুল, আব্দুল গাফফারের মতো সাবেক তারকা ফুটবলাররা।

বিজয়ের মাসে এই আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতি উঠে আসে এই কিংবদন্তিদের কথায়। সত্তরের দশকে দেশের ফুটবলে যাদের ঘিরে জাগরণ এসেছিল সেই তারকারা পেছনে ফিরে তুলে আনেন খেলার মাঠে তাদের হারানো দিনের কথা।

অনেকের মতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ফুটবলার এনায়েত। আড্ডায় উপস্থিতরা খেলোয়াড়ি জীবনে এনায়েতের মুন্সিয়ানার অনেক গল্পই তুলে আনেন।

গোলাম সরোয়ারের মতে ফুটবল মাঠের সত্যিকার অলরাউন্ডার ছিলেন এনায়েত,  'এখনকার ফুটবলারদের রানিং, পাসিং অনেক কিন্তু তারা মেধাশূন্য। মেধা ও সাহসী খেলোয়াড় ছিলেন এনায়েত। ছিলেন সব্যসাচী।'

সেসময় বাংলাদেশের ফুটবলকে কাছ থেকে দেখা সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক মোহাম্মদ কামুরুজ্জামান স্মরণ করেন এনায়েতের কুশলের কথা, 'সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন এনায়েত। এনায়েতের মতো বল প্লেমেকার আমি আর দেখিনি। ২-৩ জনকে কাটিয়ে গোল দিতেন। তার দুই পা রকেটের মতো চলতো। ঢাকার ফুটবল দেখছি ১৯৫০ সাল থেকে। এনায়েত দেশের ফুটবলের বড় অলংকার ছিলেন।'

তবে যাকে ঘিরে ছিলো আয়োজন, সেই এনায়েত ছিলেন সবচেয়ে বিনয়ী। তার সময়ের সেরা খেলোয়াড়দের প্রশংসা করেই নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করেন তিনি,   'আমি খুবই সাধারণ একজন খেলোয়াড়। আপনাদের এই ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। বিএসজেএ'র শুরু থেকেই আমি ছিলাম। এখানে অনেক আড্ডা দিয়েছি। আজ  এখানে যারা  উপস্থিত আছেন তারা সবাই অনেক বড় মাপের ফুটবলার। বিশেষ করে আসলাম (শেখ মোহাম্মদ)। অনেকের অনেক গোল আছে কিন্তু আসলামের গোলগুলো বিশেষ। কারণ তার গোলে দল জিতেছে অধিকাংশ সময়। চুন্নু ছিল একটা ম্যাজিক। বল পায়ে নিলে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের দুজনকে হাওয়া করে দিত। খুরশিদ বাবুল অত্যন্ত পরিশ্রমী ফুটবলার। এত দৌড়াতে আমি কাউকে দেখিনি।'

তবে গুণী ফুটবলারদের কদর বাংলাদেশে নেই বলেও আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠে, 'অনেকে আমাকে ভালো খেলোয়াড় বলে কিন্তু আমার চেয়ে অনেক ভালো খেলোয়াড় সান্টু, মঞ্জু। তারা দেশে থাকতে পারল না। দেশে সম্মান ও মূল্যায়ন না পেয়ে বিদেশে। ফলে অনেক বাবা-মাই তার সন্তানকে ফুটবলের দিকে দিতে চায় না।'

সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফ্ফার জানান দেশে ফিরে স্বীকৃতির জন্য এনায়েতকে অনেক অনুরোধ করলেও তিনি তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না,  'বিদেশে যাওয়ার পর আমি অনেকভাবে এনায়েত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। দেশের জন্য তার প্রয়োজনীয়তা অনেক। এবারও অনেক অনুরোধ করে তাকে দেশে আনা হয়েছে। বিদেশে যাওয়ার পর তাকে আমি অনেক বলেছি, দেশে আসতে হবে, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠাতে হবে। উনি বার বার বলেছেন, এগুলো করে কি হবে। দীর্ঘদিন ধরে তাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করে দেশে এনেছি। তাকে এই দেশের ফুটবলে অনেক প্রয়োজন।'

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এনায়েতদের অবদান কল্পনাতীত বলেই জানালেন চুন্নু,  'একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড় যিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।  আপনারা স্বাধীন বাংলার ফুটবলাররা যা করেছেন সেটা সারা বিশ্বে কেউই করেননি। আমরা যদি এই দেশে ফুটবলে কিছু না দিয়ে যেতে পারি তাহলে খুবই অন্যায় হবে।'

অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। বিসিবির পক্ষে থেকে এনায়েতকে টাই উপহার দেন তিনি। বিএসজিএ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের চার ফুটবলারের হাতে তুলে দেয় সম্মাননা স্মারক।

খেলোয়াড়ি জীবনে দেশের ঢাকার লিগে বিজি প্রেস, ওয়াবদা, ইপিআইডিসি (দেশ স্বাধীনের পর বিআইডিসি), বিজেএমসি, মোহামেডান, রহমতগঞ্জে খেলেছেন এনায়েত। প্রবল প্রতাপ নিয়ে খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে। 

১৯৯৪ সালে  দেশ ছাড়ার পর আমেরিকায় গিয়ে শুরুতে লরি চালিয়েছিলেন তিনি। পরে থিতু হন কানাডায়। সেখানেই এখন পরিবার নিয়ে বাস করেন এই কিংবদন্তি। 

এনায়েতকে নিয়ে শনিবারের এই আড্ডায় আরও উপস্থিত ছিলেন হাসানউজ্জামান খান বাবলু, ওয়াসিম ইকবাল, ইমতিয়াতজ সুলতান জনি, আব্দুস সালাম, খন্দকার রকিবুল ইসলাম, মোঃ হাসান মোঃ মালা, সংগঠক  সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ, ফজলুর রহমান বাবুল, রফিকুল ইসলাম টিপু, ইউসুফ আলী, সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক মঞ্জুরুল হক, সৈয়দ সাইদুর রহমান শামীম, উৎপল শুভ্র, মোঃ আল আমিন, মোস্তফা কামাল, কামাল উদ্দিন আহমেদ, আরিফুর রহমান বাবু, পবিত্র কুন্ডু, অঘর মন্ডল, পারভেজ আলম চৌধুরী, এটিএম সাইদুজ্জামান, মোঃ আনিসুর রহমান  সহ  বিএসজেএ'র সদস্যরা।

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser muhammad yunus speech

Signs of conspiracies by defeated forces becoming evident: CA

Political parties must make their unity against fascism more visible, says Yunus

1h ago