সব বাধা ডিঙিয়ে পেলের দেশে পাড়ি

ছবি: সংগৃহীত

অথচ ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়ার পথে ছিলেন তারা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রিয় বুটজোড়ার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা ছিল। শঙ্কর বাগতি মধু রেস্টুরেন্টের চাকরিতে ঢুকেছিলেন, দিনমজুর হিসেবে রনি মিয়া হাবিব নদী থেকে বালি উত্তোলনের কাজ নিয়েছিলেন আর অনিক দেব বর্মা বাবার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কৃষিকাজে।

তবে স্বপ্নপূরণের দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা ও মনোবল যদি থাকে, তাহলে তা কোনো না কোনোভাবে খুঁজে নেয় সঠিক পথের দিশা; দরকার পড়ে কেবল সহায়তার হাত কিংবা অনুপ্রেরণার। হবিগঞ্জের শঙ্কর, রনি ও অনিক- এই তিন কিশোরের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমির (বিএসএফএ) কল্যাণে তাদের চোখে আবার ফিরেছে স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ গোল্ডকাপে আলো ছড়িয়ে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য কিংবদন্তি পেলের দেশ ব্রাজিলে পাড়ি জমাতে যাওয়া ১১ ফুটবলারের মধ্যে আছেন তারাও।

সুন্দর ফুটবলের ধারক রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। পর্তুগিজ ভাষায় যাকে বলা হয় 'জোগো বনিতো', ইংরেজিতে 'দ্য বিউটিফুল গেম'। সেই 'জোগো বনিতোর' দেশ পেলের পাশাপাশি তৈরি করেছে চোখ কপালে তুলে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বহু খেলোয়াড়ের- গারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস, রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা- নামের তালিকা যেন শেষ হওয়ার নয়! সেখানে ফুটবলের দীক্ষা নিতে যাচ্ছেন শঙ্কর, রনি, অনিকরা।

ছবি: সংগৃহীত

দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত গোল্ডকাপে নজরকাড়া কিশোর ফুটবলারদের ৪০ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল বিকেএসপিতে। প্রতিভা ও দক্ষতাকে আরও শাণিত করতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ মেলে তাদের। এরপর চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হন ১১ জন। তাদের মিলেছে ব্রাজিলে যাওয়ার টিকিট।

ছয় সদস্যের পরিবারে শঙ্কর সবার ছোট। পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস তার বাবা, যার একসময় দৈনিক উপার্জন ছিল মাত্র ১১৮ টাকা। হবিগঞ্জের একটি চা বাগানে কাজ করে মিলত সেই অর্থ। পরিবারের অসচ্ছলতা দেখে বাবার ধকল কমাতে শঙ্কর তখন ছেড়ে দিয়েছিলেন ফুটবল। তবে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন স্বপ্নপূরণের কাছে। মুঠোফোনের ওপাশ থেকে বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে শঙ্কর বলেছেন, 'ব্রাজিলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া ১১ ফুটবলারের একজন হতে পেরে আমি সত্যিই খুব গর্বিত। এটা আমার বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের খবর। কারণ, একসময় আমার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমাদের লেখাপড়ার জন্য তাকে টাকা ধার করতেও হয়েছে।'

ব্রাজিলের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার পর ব্যারিস্টার সুমনকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি তিনি, 'হবিগঞ্জের একটি রেস্টুরেন্টে আমি কাজ করতেও শুরু করেছিলাম এবং সেখানকার ম্যানেজার আমার স্বপ্নের কথা বুঝে আমাকে অনুশীলনের জন্য এক ঘণ্টা ছুটি দিত। একদিন আমি ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমিতে ট্রায়ালে যাই এবং সুযোগ পেয়ে যাই। কিন্তু পরিবার চালানোয় বাবাকে সাহায্য করার জন্য আমি নিয়মিত অনুশীলন করতে পারতাম না। পরে আমি আমার দুর্দশার কথা ব্যারিস্টার সুমনকে জানাই। তখন তিনি আমার বাবাকে একটি দোকান চালানোর জন্য টাকা দেন। তারপর আমি বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ গোল্ডকাপে খেলি।'

ছবি: সংগৃহীত

শঙ্করের মতো রনির গল্পটাও জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ের। নদী থেকে উত্তোলন করা বালি বহনের কাজ করতেন তিনি, পেতেন দৈনিক ৫০ টাকা। তার পরিবার ছিল ঋণের দায়ে জর্জরিত। সেই বেহাল দশায় ত্রাতা হয়ে আসেন ব্যারিস্টার সুমন। অনুশীলনে যাওয়ার পথে দ্য ডেইলি স্টারকে রনি বলেছেন, 'ব্যারিস্টার সুমন ভাই আমার পরিবারকে এক লাখ টাকা না দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসলে আমার ফুটবল খেলা হতো না। আমার ভাইকে বিদেশ পাঠাতে জমি বন্ধক রাখতে হয়েছিল আমাদের। ওই টাকা দিয়ে আমরা বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নিই।'

প্রাথমিক শিক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার পর রনি বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। সিলেট বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণেও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বুট, জার্সি, মোজা ইত্যাদি কেনা ও বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি, 'আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সিলেট বিকেএসপিতে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই আমাকে চলে আসতে হয়। এরপর দৈনিক ৫০ টাকা মজুরিতে আমি নদী থেকে বালি তোলার শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে কাজ থেকে পালিয়ে আমি ফুটবল খেলতে যেতাম। একবার ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমির বিপক্ষে খেলি এবং ব্যারিস্টার সুমনের নজরে পড়ে যাই। তিনি পরে আমার পরিবারের সমস্যার কথা জেনে এক লাখ দেন জমি উদ্ধারের জন্য। এভাবে তিনি আমাকে ফুটবল খেলার পথ দেখিয়েছেন।'

ব্রাজিলে উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ মেলার পর পাসপোর্ট করতে দিয়েছেন রনি। সেই সঙ্গে তিনি দিন গুণছেন অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার, 'আমি খুবই খুশি। আমার সাফল্য দেখে আমার পরিবারও খুব খুশি। এটা আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। বিকেএসপিতে দুই মাসের ক্যাম্পে আমি কোচদের দেখানো প্রক্রিয়ার ওপর মনোযোগ দিয়েছিলাম এবং কোচরা যা শিখিয়েছিলেন, সবই করেছিলাম। ৪০ জনই খুব ভালো খেলোয়াড় এবং তাদের সামর্থ্য আছে বাকিদের চেয়ে সেরা হওয়ার।'

ছবি: সংগৃহীত

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরার একজন সদস্য অনিকের পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসাটা বাকি দুজনের মতো ভীষণ কঠিন না হলেও একদম সহজও ছিল না। পরিবারের আয়ে অংশীদার হতে একসময় তাকে বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে হতো। তবে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে পারছেন ব্যারিস্টার সুমনের সহায়তায়, 'আমি কখনোই ভাবিনি যে ব্রাজিল ক্যাম্পের জন্য ডাক পাব। আমি এখনও ঘোরের মধ্যে আছি এবং ব্রাজিলে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার বাবা-মাও খুব খুশি।'

অনিক যোগ করেছেন, 'আমি ব্যারিস্টার সুমন একাডেমির একজন ছাত্র। আমার বাড়ি থেকে একাডেমির দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমি আগে নিয়মিত অনুশীলনে যেতে পারতাম না। পরে সুমন ভাইকে জানালে তিনি আমার জন্য একটি মোটরসাইকেল কেনেন। এরপর আমি বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে খেলি এবং ব্রাজিলে উন্নত প্রশিক্ষণে যাওয়ার সুযোগ পাই।'

Comments

The Daily Star  | English

Trump says Iran has 'maximum' two weeks, dismisses Europe peace efforts

Israel's war with Iran entered its second week on Friday with the Israeli military chief warning of a "prolonged campaign"

3h ago