পাওয়ার হিটিংয়ের সমস্যা কি শুধু শারীরিক অক্ষমতায়?

Mahmudullah
নেটে বড় শটের অনুশীলনে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ছবি: ফিরোজ আহমেদ

একবার বিপিএলে বিস্ফোরক এক ইনিংস খেললেন শ্রীলঙ্কান দাসুন শানাকা। মিরপুরের মাঠে একটা ছক্কা তো গিয়ে লাগল গ্যালারি পেরিয়ে ফ্লাড লাইটের খুটিতে! শারীরিক গড়নে ক্যারিবিয়ানদের মতো বিশালদেহী নন শানাকা। তবে কীভাবে অতো জোর পেলেন?

ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, তার গুরুত্বের জায়গা স্কিল আর টাচ হিটিং। আরেকটা বিষয় এখানে জরুরি- 'ইতিবাচক মানসিকতা' বা ক্রিকেটীয় টার্মে 'পজিটিভ ইন্টেন্ট।'

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে লড়াইবিহীন হারের পর আবার বিষয়টি আলোচনায়। বিস্ফোরক ইনিংসে (২৮ বলে ৬১) ক্যারিবিয়ানদের রানকে দুশোর কাছে নিয়ে যাওয়ায় রভম্যান পাওয়েলের পেশিবহুল শরীরকে ইঙ্গিত করছেন অনেকে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়ালের মতো পেশিশক্তি নেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের। তাহলে কি অসহায়ভাবে হারের অপেক্ষা করে যেতে হবে?

বিষয়টা আসলে এতখানি সরল না। শ্রীলঙ্কার দিকেই আবার ফেরা যাক। শারীরিক আকৃতিতে গড়পড়তা বাংলাদেশি আর শ্রীলঙ্কান প্রায় একই কাতারে। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে যদি লঙ্কানদের পারফরম্যান্স দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে বিস্তর পাওয়ার হিটিংয়ের ব্যাপার আছে।

ভানুকা রাজাপাকসে, চারিথা আসালাঙ্কা, দাসুন শানাকারা পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে দ্রুত রান আনতে পারেন। রাজাপাকসে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঝলক দেখিয়ে আইপিএলে সুযোগ পান, আইপিএলেও দেখা গেছে তার হিটিং। শানাকা কদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রায় অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ জিতিয়েছেন চার-ছক্কার ঝড়ে।

ফিটনেসের দিক থেকে লঙ্কানদের চেয়ে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা কোন অংশেই পিছিয়ে নন। শারীরিক কাঠামোও প্রায় একই। প্রশ্নটা তাই সামর্থ্যটা আসলে কীসে কম? শরীরে না মনে?

গত বিপিএলে সিলেট সানরাইজার্সে কাজ করতে আসা পাওয়ার হিটিং কোচ জুলিয়ান উড দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলছিলেন, পাওয়ার হিটিংয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতা সবচেয়ে জরুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের ছক্কা হয়ত ৯০ মিটার যাবে, আপনার ৬০ মিটার। কিন্তু ৬০ মিটার পার হলেই ছক্কাই হচ্ছে কিন্তু। তার মতে, 'মাথাটা খোলা রাখতে হবে। আপনি যদি টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ২০ বলের মধ্যে তিনটা ছক্কা মারতে পারেন তাহলে দারুণ। কারণ তখনো আপনার হাতে ১৭ বল আছে। কাজেই খুব চতুর হতে হবে।  নিজের শক্তির উপর আস্থা রাখাটাই ভাল।'

পেশির ঘাটতি আরেকটা দিক থেকে পুষিয়ে নিতে বলছিলেন তিনি।  পেশিবহুলদের মিসহিটও ছক্কা হয়ে যায়। কিন্তু আপনাকে ছক্কা বানাতে হলে স্কিল আর টাচে গুরুত্ব দিতে হবে, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের তিনি বলছিলেন, 'তোমাদের আছে স্কিল আর টাচ। এখন পাওয়ার দরকার। কিন্তু তোমরা তোমাদের পাওয়ার ভিন্নভাবে আয়ত্ত করতে পার। তোমাদের অনেক বেশি ছন্দ এবং টাইমিংয়ের উপর ভরসা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্মার্টনেসের বিকল্প নেই। যদি তারা এই চিন্তায় এগুতে পারে তাহলে তাদের ব্যাটিং বিকশিত হবে।'

ফেরা যাক ডমিনিকার দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৩ রান তুলার পরই কি ম্যাচ হেরে বসেছিল বাংলাদেশ? ম্যাচ শেষে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কথার ভেতরের মানে খুঁজতে গেলে এটাই দাঁড়ায়। তিনি বোলারদেরই দায় দিয়ে গেলেন। সাকিব আল হাসানের উদ্দেশ্যহীন ইনিংসটাকে করে গেলেন প্রশংসা। বোলারদের দায় নিশ্চয়ই আছে। তারা আরও বল করলে লক্ষ্যটা হয়ত কম থাকত।

কিন্তু যখন বড় রান হয়েই গেছে। আপনি কি হার মেনে নিবেন হারার আগেই? দুই ওপেনার ও মাহমুদউল্লাহ মারার চেষ্টাতেই আউট হয়েছেন। ২৩ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর বাকিটা সময় আর কোন চেষ্টা দেখা গেল না ব্যাটিংয়ে। হালের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শুরুতে ২-৩ উইকেট পড়লেও পাল্টা আক্রমণে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচের পরিস্থিতি বদলে দেয় দলগুলো। খেলাটা ২০ ওভারের। একটা জুটি যদি ১০ ওভার স্থায়ী হয়ে যায় তাহলে ২৩ রানে ৩ উইকেট একটা সময় গিয়ে হয়ে যায় ১০০ রানে ৩ উইকেট। বাংলাদেশেরও সেদিন জুটি হলো। কিন্তু সাকিব আর আফিফ হোসেনের জুটি এগুলো মন্থর পথে। ১৭তম ওভারে এক পর্যায়ে সাকিবের রান ছিল ৩৭ বলে ৩৫। তিনি ফিফটি পার হন ৪৫ বলে। ততক্ষণে ম্যাচের কিছু আর বাকি নেই। তার ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশ খেলছে সম্মানজনক হারের লক্ষ্যে।

এখানেই প্রশ্নটা আসে মানসিকতার। আপনি রান তাড়ার চেষ্টা করে যদি বিশাল ব্যবধানে হেরে যান তাহলে একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।  আর চেষ্টা না করে আগেই হার মেনে খেললে অক্ষমতার এক বার্তাই দিয়ে দেন প্রতিপক্ষকে। খেলাধুলোয় মনস্তাত্ত্বিক  এই পরাজয়ের, দুর্বল মানসিকতা প্রদর্শনের ধকল হয় দীর্ঘস্থায়ী। 

বাংলাদেশে পাওয়ার হিটিংয়ের অভ্যাস না থাকার পেছনে বড় আরেকটি প্রশ্নের জায়গা প্রস্তুতি। ঘরের মাঠে যেসব উইকেটে খেলে ম্যাচ প্রস্তুতি হয় তাতে শটের রেঞ্জ হয়ে যায় সীমিত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে দুই সিরিজ জিতল। এবং সেটাকে অতিকায় করে প্রচার করা হলো। এই দুই সিরিজে খেলা হয়েছে অতি মন্থর ও টার্নিং উইকেটে। যেখানে একশো রান করাই ছিল মুশকিল।

এই দুই সিরিজের ভুল প্রস্তুতি, ফাঁপা আত্মবিশ্বাস পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের করুণ পরিণতি নিশ্চিত করেছে।

এখন টি-টোয়েন্টি ব্যর্থতায় বারবারই প্রতিপক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে একটি কথা বলা হয়, 'আমাদের তো ওদের মতো পাওয়ার হিটার নাই, অতো পেশিবহুল খেলোয়াড় নাই।' কিন্তু পাওয়ার হিটিং তো কেবল বড় বড় ছক্কায় নয়, বাউন্ডারি দিয়েও মেটানো যায়। সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের মতে তাই পেশিই সবটা নয়, স্কিল দিয়েও পোষানো যায়, 'আমি মনে করি না পাওয়ার হিটার সব সময় পেশিশক্তি বা শারীরিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে হয়। এটা একটা স্কিল যা আপনাকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Yunus thanks foreign medical teams for treating Milestone crash victims

A delegation of 21 physicians and nurses from Singapore, China, and India met Yunus at Jamuna

4h ago