রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি

জামদানিতে দ্যুতি ছড়ালেন বাঁধন

আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: সংগৃহীত

'মুসকান জুবেরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বইয়ের প্রচ্ছদের মাধ্যমে। তার কাজল কালো গভীর চোখ, কপালের মাঝখানে আকর্ষণীয় লাল টিপ এবং বাকি সবকিছুই কীভাবে যেন সেখান থেকেই মিলে গেছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননির পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং হইচইয়ের অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বিস্তারিত তথ্য জানানোর পর, আমি আরও ভালোভাবে জুবেরীকে বুঝতে পারলাম। তাদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য, আমি আমার মায়ের পুরনো সুতি জামদানি শাড়ি পরে তাদেরকে একটি ছবি পাঠালাম। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি!'

-আজমেরী হক বাঁধন।

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি ওয়েব সিরিজটি আমি দেখেছি প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথমত, বাঙালি লেখকদের লেখা থ্রিলারের প্রতি আমার ভালোবাসা (এ সিরিজটিতে আবার অতিপ্রাকৃত বিষয়েরও একটি ইঙ্গিত ছিল!)। দ্বিতীয়ত, সিরিজের মূল চরিত্রগুলো, যেসব চরিত্রে আমার প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন (আজমেরী হক বাঁধন এবং রাহুল বোসের বিরাট ভক্ত আমি)। আর সর্বশেষ এবং বিশেষ কারণটি হলো সিরিজটির বিশেষ ধরনের পোশাক-আশাক। বিশেষ করে বাঁধন অভিনীত মুশকান জুবেরী চরিত্রের পোশাকগুলো।

বাঁধনকে যে পুরো সিরিজ জুড়ে বেশিরভাগ সময় চমৎকার সব ঢাকাই জামদানি পরতে দেখা গেছে, তা সত্যিই নজরকাড়া ছিল। এসব শাড়িতে বাঁধনের চোখ-ধাঁধানো দ্যুতি, আমাকে  আবারও নতুন করে জামদানির কারুকাজের প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে।

মানুষ যেখানে জামদানি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে এবং বাড়তি নানা কিছু (অপ্রয়োজনীয় বলাই ভালো) যোগ করে এর মূল নকশা প্রায় ঢেকে ফেলছে, রেক্কা তখন আবারও প্রমাণ করে দিল যে জামদানির ক্ষেত্রে অত্যাধুনিকতার চেয়ে অকৃত্রিমতাই বড় বিষয়। অর্থাৎ, জামদানি নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সুযোগ বা দরকার-কোনোটাই নেই।

ওয়েব সিরিজটির শুরুর দৃশ্যে বাঁধনকে দেখা গেছে ডেইজি ফুলের মতো সাদা রঙে প্যাসলি মোটিফ এবং ছোট ছোট লাল বিন্দুর নকশা করা একটি জামদানিতে। সঙ্গে ছিল আধুনিক কাটের ব্লাউজ, পুরনো রুপার গয়না এবং মেরুন-লাল রঙের শাল। এ সাজপোশাকে সুন্দরী বাঙালি মেয়েটি  যেন মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছিলেন। বইটি আগে পড়া না থাকলে, ওই শাড়ির দিকেই শুধু প্রশংসার চোখে তাকিয়ে থাকতাম আমি। গল্পে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে যেত।

আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: সংগৃহীত

জুবেরীর দ্বিতীয় শটটিও সমানভাবে আকর্ষণীয় ছিল। এ সময় তিনি পরেছিলেন ওয়াইন-রঙা মোটিফের একটি বিশেষ জামদানি। সঙ্গে ছিল একটি মঙ্গলসূত্র স্টাইলের নেকপিস, ম্যাচিং লিপস্টিক এবং কপালে টিপের মতো একটি ছোট লাল বিন্দু।

আমি যখন ভাবছিলাম যে, এ শাড়িটির মতো অন্য কিছু আর এ চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না, ঠিক তখনই পান্না সবুজ রঙের একটি জামদানি আর চমৎকার মুক্তার নেকলেস পরে পর্দায় এলেন জুবেরী। সঙ্গেসঙ্গেই যেন চরিত্রটি নিজস্ব চিন্তা, অনুভূতি ও প্রত্যয় নিয়ে বাস্তব জীবনের একজন মানুষে পরিণত হলো।

মুসকান জুবেরীর চরিত্রে অভিনয় করে বাঁধন আবারও প্রমাণ করলেন যে, বাঙালি নারীদের মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। সঠিক পোশাক, সরলতা আর আত্মবিশ্বাস তাদের যে কোনো দিন নতুন রূপে সাজাতে পারে।

প্রথম কয়েকটা শটের পরে সিরিজে পোশাকে খুব বেশি পরিবর্তন আনা হয়নি। একটি এক রঙা চাপা-সাদা সিল্ক শাড়ি আর একটি বাদামী সিল্ক শাড়ি পরতে দেখা গেছে জুবেরীকে। কিন্তু, এরপর প্রযোজকরা সবচেয়ে বড় চমকটি নিয়ে হাজির হলেন।

বিশেষ ওই দৃশ্যে হলদে-সবুজ জামদানি পরা জুবেরীকে ঠিক নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল লাগছিল। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, অভিজাত ওই শাড়িসহ তার উপস্থিতিতে যেন পর্দাই আলোকিত হয়ে উঠেছিল।

স্টাইলিংয়ের এ মহিমা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, এ বিষয়ে অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা না বললেই নয়। হাস্যময়ী বাঁধনেরও তার উৎসাহী ভক্তদের সঙ্গে এ বিষয়ে অনেক কিছু শেয়ার করার ছিল।

আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: সংগৃহীত

বাঁধন বললেন, 'জাদুকরী এ ঘটনা ঘটেছে আমাদের কস্টিউম ডিজাইনার সঞ্চিতা ভট্টাচার্য, মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু ও হেয়ার মেকওভার আর্টিস্ট সিমা ঘোষের মত অত্যন্ত সৃজনশীল লোকদের কারণে। তারা জাদুকরের চেয়ে কোনো অংশেই কম নন। স্ক্রিপ্ট, পরিচালনা ও অভিনয়ের সঙ্গে তারাও আমাকে মুসকান জুবেরীকে প্রাণ দিতে সাহায্য করেছেন।'

মিশুক প্রকৃতির বাঁধনের কাছ থেকে আমরা স্টাইলিং সম্পর্কে অনেক তথ্যই পেলাম। কিন্তু, সবচেয়ে বড় তথ্যটি তখনো মেলেনি।

ওই চমৎকার জামদানিগুলোর উৎস কী- জানতে চাইলে হাসতে হাসতে বাঁধন বললেন, 'থ্যাংক গড, আপনারা জানতে চেয়েছেন। আমি জায়া ব্র্যান্ডের অনেক বড় ভক্ত। এটি দেশীয় একটি জামদানি হাউজ। অনলাইনে খুব সক্রিয়। ঢাকা ছাড়ার অল্প সময় আগে এর মালিকের কাছে কয়েকটি জামদানি চেয়েছিলাম আমি। তিনি স্বেচ্ছায় খুব কম সময়ের মধ্যে সেগুলো পৌঁছে দেন। বাকিটা পর্দায়ই দেখেছেন।'

হ্যাঁ, আমরা সত্যিই পর্দায় যাদু দেখেছি। কী একটা 'বিশেষ মিশ্রণ' যে ছিল! আমাদের স্মৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে থাকবে এটি। 

রেক্কার গল্প নিজের সুবিধার জন্য পুরুষদের প্ররোচিত করা এক ষড়যন্ত্রকারী নারীকে নিয়ে হলেও, আমাদের অনেকের কাছে পর্দায় তার পোশাক ও স্টাইলিংই সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকের রহস্যময় বাঙালি অভিজাতদের পটভূমি প্লটলাইনে যুক্ত হওয়ায়, এটি আরও দশগুণ বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে। সর্বোপরি, নিজেদের অতীত, বংশানুক্রম ও ঐতিহ্যবাহী নকশার অনন্য গল্প ছাড়া আমাদের কী-ই বা পরিচয় আছে?

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Customs flags hurdles at 3rd terminal of Dhaka airport

Customs House Dhaka said it has found more than a dozen issues related to infrastructure, security, and operational readiness of the new terminal

12h ago