সোশ্যাল মিডিয়ায় যাপিত জীবন

লাইক, শেয়ার, কমেন্ট কিংবা টুইট-রিটুইটের ঘেরাটোপে বন্দী মানুষ। যাপিত জীবনের সিংহভাগ সময় জুড়েই থাকছে সবুজ আর নীল আলোর দিশেহারা হাতছানি।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার, ইমো আর টিকটকের মতো অ্যাপে সীমাহীন আসক্তির পরিধিতে অবধারিতভাবেই ঢুকে যাচ্ছে আট থেকে আশি বয়সের সকলেই। ভার্চুয়াল দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে খেই হারাচ্ছে গোটা দুনিয়া। আমরা সবাই যেন আজ সোশ্যাল মিডিয়ার স্রেফ দাসত্ব করে চলেছি।

একটি মাত্র স্মার্টফোন সবকিছুতেই বসিয়েছে বিশাল থাবা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এমনকি সামাজিক জীবনকেও এক অশুভ অবগাহনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই ছোট আয়তাকার ডিভাইসটি। তাই ভয়াল আশংকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একটি মাত্র বাক্য- 'সোশ্যাল মিডিয়া আশীর্বাদ না অভিশাপ'।

এমন আমি ঘর বেধেছি আহারে যার ঠিকানা নাই

'তুমি এতোটা বিধ্বংসী হয়ে উঠবে, আদতেই কি তাই কল্পনা করেছিলাম আমি? শুরুতেই কি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, সে কি আনন্দ আমার! আমারও একটা আছে, কতজনকেই বুক চেতিয়ে বলেছি। এক দশক যেতে না যেতেই তুমি আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে হাই বিপি, ডিপ্রেশন আর হতাশার গভীর সাগরে নিমজ্জিত করে, দোর্দণ্ড প্রতাপে এখন তুমিই শাসন করছো সব।'

বুঝতে বাকি নেই এখানে কার কথা বলা হচ্ছে। এই স্ট্যাটাসটি আমার এক ফেসবুক বন্ধুর। প্রবল পরাক্রমশালী এই সোশ্যাল মিডিয়া সত্যিই সব কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের সুপ্ত আকুতি, সুতীব্র অনুভূতি আর ভালো লাগার ফ্যাক্ট-ইনফ্যাক্টে ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে রীতিমতো। সারাদিন শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে– যে যেভাবে যে অবস্থানেই থাক, নজর সবসময় 'ডাউন টু আর্থ' স্মার্টফোন কিংবা ওই ট্যাবলেটে। পাশের মানুষটির দিকে তাকানোরও যেন জোঁ নেই। কৃত্রিম বন্ধনের ত্রিমাত্রিক মোহে আচ্ছন্ন হয়ে অন্তর্জালের যে ঘরে আমরা বাস করছি তা আসলেই ঠিকানাবিহীন। অসত্যে ভরা, একদম ঠুনকো, বড্ড শ্রীহীন। এর একটা সীমারেখা টানা খুব জরুরি।

আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে কী যে ভাবি আনমনে

শুক্লা দ্বাদশী, চন্দ্রভূক অমাবস্যা সব গেল, তবুও তিন প্রহরের বিল, পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা দেখা হলো না। সুগন্ধি রুমালের যে গন্ধে বরুনার বুক আতরের গন্ধে মুখরিত হওয়ার কথা, সেই বুক আজ খাঁ-খাঁ করে। অচেনা, নিঃসাড়, প্রাণহীন সেই বুকটা আজ হয়ে উঠেছে হালের ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইন্সটাগ্রামের সুবিশাল মহীরুহ। যেখানে কোপ আপ, শো আপ কিংবা এক্টিভিটি-ডিএক্টিভিটির  দ্বারা পরিমাপ হয় নিজের অবস্থান, জানাশোনা বা অ্যাকশন  রি-অ্যাকশনের চলমান গতিপ্রকৃতি।

হেঁশেল ঘর থেকে শোবার ঘর– বাদ নেই যেন কোনো কিছু। সবকিছুর আপডেট দেওয়া চাই। কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কী কিনছি, কী শুনছি এসব নিত্যকার ব্যাপার এমন সব মোড়কে নিজের ওয়ালে উপস্থাপন করা হচ্ছে যাতে প্রাইভেট আর পাবলিক লাইফের সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে হরহামেশা। ক্ষণে ক্ষণের এই যে আনমনা ভাবনা তা বাড়াচ্ছে মানসিক অস্থিরতা, মস্তিষ্কের অসাড়তা। কমে যাচ্ছে মনোযোগ, দেখা দিচ্ছে স্লিপিং ডিসঅর্ডার, ইনসমনিয়া, হতাশা, উদ্বিগ্নতা। একাকীত্বতা বাড়িয়ে যাপিত জীবনের সবকিছুতে ডিসটারবেন্স তৈরির সহায়ক উপাদান হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া।

তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার

'পৃথিবীর পুরানো সে-পথ, মুছে ফেলে রেখা তার—

কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ, চিরদিন রয়!

সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব—

নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়!'

জীবনানন্দের 'স্বপ্নের হাতে' কবিতার এই লাইনগুলোকে অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই। পুরনোকে মুছে ফেলে নতুনে অভ্যস্ত হওয়া খুব সহজাত স্বভাব মানুষের। প্রযুক্তির নিত্যনতুন উৎকর্ষতা ডিজিটাল জীবনযাপনকে আরও বেগবান করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা নিজের মন-মননশীলতা কিংবা স্বকীয়তাকে বিকিয়ে নয়। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি মনের মধ্যে নেগেটিভিটির পাহাড় গড়ে তোলে। জাজমেন্টাল করে তোলে মানুষকে। যে ডাইনিং টেবিলে, ড্রয়িং রুমে বা বন্ধুদের আড্ডায় মুখরিত হতো চারপাশ, সে সবকিছু থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়ে চোখ আটকে আছে স্মার্টফোনের নীল-সবুজের গামা রশ্মিতে। সবাই যে যার মতো বুঁদ হয়ে আছে ভার্চুয়াল জগতে।

এসো শ্যামল সুন্দর

নোওম চমস্কি সোশ্যাল মিডিয়াকে দুদিকে ধারওয়ালা তলোয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আরও অনেকেই ডিজিটাল কোকেনসহ নানা অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিকে। কিন্তু যে যাই বলুক, এই মোহগ্রস্ততা থেকে বের হওয়া আসলেই কঠিন। এই আসক্তি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে হবে, এই দীক্ষা দিতে এই লেখা নয়। তবে এই মোহগ্রস্ততা যেন কোনোভাবেই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানসিক জীবনে প্রভাব না ফেলে, চলমান ভাবনায় সেটারই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় কতোটুকু সময় দিবেন বা কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন তা জানা খুব জরুরি।

বাস্তব আর ভার্চুয়াল দুনিয়ার পার্থক্য বুঝে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে দাড়ি-কমা বসাতে শিখুন। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ ব্যবহার করুন, অসুবিধা নেই। তবে এর একটা সীমারেখা টেনে জোর গলায় বলুন না একবার, 'জানি বাহিরে আমার তুমি, অন্তরে নও'। তবেই সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচকতা সত্য-শ্যামল-সুন্দর হয়ে উঠবে।

Comments

The Daily Star  | English
Unhealthy election controversy must be resolved

Unhealthy election controversy must be resolved

Just as the fundamental reforms are necessary for the country, so is an elected government.

8h ago