‘ব্যর্থতা’র পথ ধরেই গুগলে আদনান

দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী নাফিউল আদনান চৌধুরী। সেই হতাশায় কেটেছে অনেক দিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরুর পর প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অংশ নেন প্রায় ৪ শ'র মতো প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায়। তবুও প্রোগ্রামিংয়ের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আইসিপিসি'র (ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট) চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি।

তবে, শেষ পর্যন্ত হাল না ছাড়া সেই আদনানকে ডেকে নিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল।

১৯৯৮ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ২ শিক্ষার্থী ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনের প্রকল্প হিসেবে শুরু হওয়া এই সার্চ ইঞ্জিন এখন সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে।

আদনান কাজ করবেন গুগলের আয়ারল্যান্ড (ডাবলিন) অফিসে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার (সাইট রিলায়েবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার) হিসেবে। আগামী জুন-জুলাইয়ে তার কাজে যোগ দেওয়ার কথা। এর আগে, গত ৩১ জানুয়ারি গুগলের পক্ষ থেকে তার কাজের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

গতকাল শনিবার সিলেটে অবস্থানরত আদনানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে গুগল পর্যন্ত যাওয়ার পথ পরিক্রমায় তার লড়াইয়ের গল্প।

আদনান জানান, তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন।

'আমি আসলে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পাইনি। পাবলিকে দ্বিতীয়বার ট্রাই করতে ১ বছর গ্যাপ দিয়েছিলাম। তারপরেও হয়নি,' বলেন আদনান।

আদনান বলেন, '২০১৩ সালে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেই সিলেট এমসি কলেজ থেকে। এরপর আমি সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে সিএসই বিভাগে ভর্তি হই। সেখানে আমার প্রথম বছরটা কেটেছে পাবলিকে চান্স না পাওয়ার ডিপ্রেশনে। দ্বিতীয় বছর থেকে আমি প্রোগ্রামিং শেখা করা শুরু করি।'

এরপর মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের উৎসাহে তিনি আইসিপিসিতে অংশ নিতে শুরু করেন। তার মতে, তখন থেকেই তার বিষণ্ণতা কাটতে শুরু করে। মনে হয়, কিছু একটা হয়তো করতে পারবেন জীবনে।

আদনান বলতে থাকেন, 'প্রোগ্রামিং বিষয়টা তো তেমন সহজ কিছু না। প্রথম দিকে কিছুটা সহজ থাকে। পরের প্রতি ধাপ কঠিন হতে থাকে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি প্রোগ্রামিং কম্পিটিশন করেই কাটিয়েছি। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে চার শ'র মতো কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছি।

'এ ছাড়া বিভিন্ন সাইটে প্রব্লেম সলভিংয়ের একটা ব্যাপার আছে। সাইটগুলোতে প্রব্লেমের ডেসক্রিপশন দেওয়া থাকে। আমাদের সেগুলো সমাধান করতে হতো। সবমিলিয়ে বিভিন্ন সাইটে আমার ২ হাজারের মতো প্রব্লেম সলভ করা আছে।'

আদনান বলেন, 'এগুলো করার সময় অনেকবার মনে হয়েছে আমি পারছি না। ছেড়ে দেবো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ও তেমন পরিচিত ছিল না। এমন কোনো উদাহরণ ছিল না যাকে সামনে রেখে আমি এগুতে পারি। সেখানে আমরা নিজেরা নিজেরা একটা কমিউনিটি তৈরি করি পরস্পরকে সহযোগিতা করতে, একে অপরের কাছ থেকে শিখতে।'

এদিকে আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপের কথা জানিয়ে আদনান আরও বলেন, 'আমার একটা স্বপ্ন ছিল আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ নেওয়ার। ওই জায়গাটিতে আমি খুবই অসফল, ধারে-কাছেও যেতে পারিনি কখনো।'

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে মার্চেই ঢাকার একটি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন আদনান। কিন্তু, তার পরিকল্পনা ছিল আরও বড় কিছু করার। তিনি বলেন, 'আমার লক্ষ্য ছিল বড় কোনো কোম্পানিতে কাজ করা। সেটা যে গুগল হবে তা ভাবিনি। এটা নিয়ে পরিকল্পনা করা একটা ভয়ের ব্যাপার ছিল।'

গত বছরের মাঝামাঝি গুগল থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক এলে ঢাকার চাকরি ছেড়ে সিলেট চলে যান আদনান। কারণ তখন তার প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি।

গুগলে তার কাজের ধরন কেমন হবে জানতে চাইলে আদনান বলেন, 'সেখানে আমার পদ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। যেটাকে ওরা বলছে সাইট রিলায়েবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার। একটা সাইটের পারফরমেন্স, অ্যাভেইলিবিলিটি, সবাই সেটা ঠিকঠাক ইউজ করতে পারছে কিনা, কতটুকু স্পিড আছে, পারফরমেন্স কেমন এসব কিছু দেখভালের দায়িত্ব থাকে এই টিমের। পাশাপাশি ডেভেলপমেন্টের বিষয়ও থাকবে।'

সব ঠিকঠাক থাকলে জুন-জুলাইয়ে সস্ত্রীক আয়ারল্যান্ডের পথে রওনা হবেন আদনান। সেখানে কাজের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সুবিধার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই সংক্রান্ত ৮ পাতার একটি কাগজ ওরা আমাকে দিয়েছে। সেটা এখনো পড়ে শেষ করতে পারিনি আমি। গুগল তো এসব দিক থেকে বেস্ট। ওরা হেলথ ইনস্যুরেন্স, ডেন্টাল ইনস্যুরেন্স কাভার করবে। ওখানে যাওয়ার পর যদি তাদের দেশের ভাষা শেখার ইচ্ছা থাকে, আমার স্ত্রীর শেখার ইচ্ছা থাকে তাহলে তারা বড় একটা অ্যামাউন্ট দেবে।'

'টেকনিক্যাল কোনো জিনিস শিখতে চাইলে তার ৩ ভাগের ২ ভাগ তারা পে করবে। এর বাইরে ফটোগ্রাফির মতো কিছু শিখতে চাইলে ৩ ভাগের ১ ভাগ তারা পে করবে,' যোগ করে তিনি।

আদনানের বাবা শামসুল হক চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।

আদনান বলেন, 'আমি আমার পরিবার, আশপাশের বন্ধুবান্ধব, আত্নীয় ও পরিচিতজনদের সহযোগিতা ছাড়া এতদূর আসতে পারতাম না। তাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এই প্রাপ্তিটা তাদেরও।'

Comments

The Daily Star  | English

Govt plans to include private sector in US tariff talks

Bangladesh is currently reviewing the proposals and will send a response within the next couple of days, Commerce Secretary Mahbubur Rahman told The Daily Star yesterday over the phone.

14h ago