আমরা চলে যাচ্ছি কেন?

'এখানে চলে আসার পেছনে উচ্চশিক্ষা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তবে শিগগির দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাও আমার নেই। প্রত্যেক দেশেই নানা রকম সমস্যা থাকে জানি, নিজে উন্নত বিশ্বের যে দেশে আছি সেটাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তুলনা করলে দেখতে পাই, বাংলাদেশের চেয়ে এখানে আমার জীবনকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারব।' এমনটাই বলছিলেন কানাডার টরোন্টোতে গ্র্যাজুয়েশনের শিক্ষার্থী তাসনীম তাহরিন (২৫)।
বাংলাদেশি তরুণদের মাঝে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা বা ইচ্ছা বেড়েই চলেছে। একটি বাড়ন্ত অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও, সংজ্ঞা অনুযায়ী যেখানে জীবনধারণের মান ভালো হওয়ার কথা, তরুণরা কেন জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে এতটা আগ্রহী?
মনে হয় যেন বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, এ দেশে তাদের জীবনযাপন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত বুঝতে আমরা ১৭ থেকে ২৮ বছর বয়সী ২৪০ জন তরুণের মাঝে একটি জরিপ চালাই। বাংলাদেশে বসবাস করতে তারা কেমন বোধ করছেন, বিদেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না, তাদের পরিকল্পনার পেছনের কারণগুলো এবং এ ব্যাপারে তাদের পরিবারের অনুভূতি ইত্যাদি বিষয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করি।
জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই জানান, তারা দেশের বাইরে চলে যেতে ইচ্ছুক। এর কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেন বিদেশের উন্নত জীবনযাত্রা, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের অনিরাপদ পরিস্থিতি।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শিক্ষার মান উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে অনেকেই বিদেশের মাটিতে উন্নত মানের শিক্ষা নিতে চান। দেশের বাইরে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শিক্ষার মান নিয়ে অসন্তোষ ছিল খুবই স্পষ্ট।
বিদেশে স্থায়ী হতে চাওয়া ৮২ শতাংশ তরুণই জানিয়েছেন, বিদেশের মাটিতে উচ্চশিক্ষা হলো তাদের কাছে দেশের বাইরে যাওয়ার উপায়।
শিক্ষা এবং নিরাপত্তার পাশাপাশি আর যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো, জীবনধারা। জরিপে অংশ নেওয়া অনেকে এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি আর অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমরা কেউই মুক্ত বাতাস, বিনোদনের জায়গা বা সবুজ প্রকৃতি পাচ্ছি না। শহুরে জীবন প্রতিনিয়ত আরও বেশি নীরস এবং বিষণ্ণ হয়ে উঠছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহান আজমাইন (২৩) বলেন, 'আমার মনে হয় আমাদের চারপাশ কেমন বদ্ধ আর নিঃসাড় হয়ে আসছে। ফলে সৃজনশীল মানুষদের কাছে মনে হচ্ছে যেন তাদের চিন্তা, সাধনা, প্রচেষ্টা সবকিছুকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে।'
ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিরাপদ শহরের সূচকে ঢাকা ছিল সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ শহর। ১৩৪ জন নারী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ জানান, দেশে নিরাপত্তার অভাবই তাদের দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে বাধ্য করছে। তবে বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কারণে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বিদেশে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে বটে।
দেশের বাইরে যেতে পরিবার ও সমাজের বাধার ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা তাবাসসুম বলেন, 'আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাই। বিগত কয়েক বছরে এ দেশে নারীদের নিরাপত্তার হাল দেখে সন্দেহ হয়েছে ভবিষ্যতে না জানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আপাতত বিদেশ যেতে আমার একমাত্র বাধা হলো, আমি এখনো বিয়ে করিনি। আমার পরিবারের ধারণা একা যাওয়ার চেয়ে বিয়ে করে পার্টনারের সঙ্গে যাওয়া ভালো!'
সম্প্রতি তরুণ ও বয়স্কদের চিন্তাভাবনার ব্যবধান খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, আমাদের পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। সেইসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা তৈরি করছে। তাই তারা মনে করেন, অন্য দেশে গিয়ে বাকস্বাধীনতা ও নিজ নিজ অধিকার চর্চার মাধ্যমে মুক্তভাবে জীবনযাপন সম্ভব। বর্তমানে ধর্মীয় মৌলবাদের কারণে এ ধরনের অসঙ্গতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতাও এ দেশে বসবাস করতে না চাওয়ার অন্যতম কারণ।
তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজাল ভেঙে নিজেদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন, কথা বলছেন পুরোনো নানান ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ হওয়ার কারণে তরুণ ও বয়স্কদের চিন্তাভাবনার ব্যবধান আমরা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।
'মানসম্মত উচ্চশিক্ষার জন্য আমি বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। তবে এক পর্যায়ে বুঝলাম শুধু তাই নয়, দেশ ছাড়ার আরও কারণ রয়েছে। আমি চাই আমার নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিতে, ক্যারিয়ারের বিভিন্ন ক্ষেত্র চড়ে বেড়াতে। দেশে থাকলে স্বাধীনভাবে বাঁচার পথটা বেশ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া আমি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পছন্দ করি, এমন কোনো দেশে যেতে চাই যেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের চর্চা আছে,' বলছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী লিনাহ মেহজাবিন (২২)।
'বাবা-মাকে অনেক কষ্টে বোঝাতে হয়েছে যে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিয়ে কোনো শর্ত হতে পারে না। তাদের আপত্তির কারণে আমার বিদেশে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছিল। তারা এখনো মনে করেন, আমার বিয়ে করেই যাওয়া উচিত, তবে আগের মতো চাপ দেন না। তবে হ্যাঁ, মেয়ে বলে আমার রাস্তা কঠিন তো হয়েছেই,' যোগ করেন তিনি।
তবে কারো কারো জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে অচেনা মাটিতে পাড়ি দেওয়াটা যেন সব বিসর্জন দেওয়ার মতো ব্যাপার। দেশে হাজারো সমস্যায় থাকলেও দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না তারা।
আমাদের জরিপে দেখা যায়, যারা দেশ ছাড়তে চান না তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশের প্রধান কারণ পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাওয়া।
'পরিবারের পাশে থাকতে চাওয়াই আমার দেশে থাকবার মূল কারণ। আমি তাদের সার্বিক দায়িত্ব নিতে চাই। এ ছাড়া দেশের প্রতি খুব শক্ত আবেগ জড়িয়ে রয়েছে আমার। এই সমাজ আমাকে গড়ে তুলেছে, আমিও চাই সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে,' বলছিলেন ডিজিটাল পাওয়ার হাউজের ২৫ বছর বয়সী ট্রেইনি ইঞ্জিনিয়ার মুমনুন জাওয়ার।
'এখানে নানারকম সমস্যা তো আছেই, তবে চেষ্টা করছি মানিয়ে নিতে। এ দেশে কমবেশি সবারই এসব ঝামেলা পোহাতে হয়। তবে আমি এখনো আশাবাদী। আমি বিশ্বাস করি সামনে সুদিন আসবে, ধীরে ধীরে অনেক সমস্যার সমাধান হবে,' যোগ করেন তিনি।
মেধা পাচার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা বেশ শোচনীয়। ফান্ড ফর পিসের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মেধা পাচারের সূচক ৭ দশমিক ৬, যা গড় সূচক ৫ দশমিক ৫ এর তুলনায় অনেক বেশি। শুধু ঢাকা শহরেই বাস করেন ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ। বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচক ২০২১ অনুযায়ী, এ শহরকে বিশ্বের চতুর্থ বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নিজ শহরে কাজের অভাব, উচ্চশিক্ষা কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা শহরে প্রতি বছর পাড়ি জমান প্রায় ৪ লাখ মানুষ। এ কারণে ঢাকায়ও দেখা যায় চাকরির সংকট। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম সমস্যাগুলোর একটি হলো কাজের সুযোগ না পাওয়া। স্নাতক উত্তীর্ণ হলেও মিলছে না চাকরির নিশ্চয়তা। বিভিন্ন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়েই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আর অভিজ্ঞতা খোঁজেন, ফলে চাকরির বাজারে সদ্য স্নাতকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া সালমা ফারিহা (২৪) বলেন, 'এ দেশে নেটওয়ার্ক ছাড়া ভালো চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে যারা কেবল অনার্স পাস তাদের জন্য। রিক্রুটাররা অনেক স্কিল চান, কিন্তু সে অনুযায়ী বেতন দিতে চান না। কোনো কোনো কোম্পানি কাজের সময়ও বাড়িয়ে দিয়েছেন, সপ্তাহে ৬ দিন অফিস করার নিয়ম করেছেন। এগুলো দেখার কেউ নেই, সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের ওপর একরকম গজব নেমে আসে!'
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের দেশ ছাড়তে চাওয়ার পেছনে উন্নত জীবনযাত্রা, নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক মতভেদ, মানসম্মত শিক্ষা, চাকরির সুযোগ ইত্যাদি নানাবিধ কারণ রয়েছে—তা স্পষ্ট। কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবলে যে দেশ সুষ্ঠুভাবে এগোতে পারে না, তা বুঝতে পেরে অনেকে একরকম বাধ্য হয়েই ছাড়ছেন এই মাটি, এই জল, এই হাওয়া।
এই জরিপের ফলাফল আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়, তরুণদের এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে বাংলাদেশ কী করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে?
অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম
Comments